অতিরিক্ত আইজিপির বাসায় মৌসুমীকে হত্যার অভিযোগ মায়ের

ওকে নিউজ স্পেশাল নারী প্রচ্ছদ শিশু অধিকার শিশু/কিশোর

তিন বছর ধরে মেয়ে মৌসুমীর (১১) মুখখানা দেখতে পান না মাজেদা বেগম। শুনতে পান না ‘মা ডাক’। যখন দেখলেন, তখন প্রিয় সন্তানের দেহে আর প্রাণ নেই।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই তার বাড়িতে শত শত নারী-পুরুষের ভিড়। মৌসুমীর লাশ ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যখন এসে পৌঁছাল তখন রাত সাড়ে আটটা। অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনে জমায়েত হলো শত শত মানুষ। মেয়েহারা মাজেদার কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে চারপাশ। এ সময় উপস্থিত জনতা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের দাবি জানায়।

এরপর লাশ দাফন নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী সামাজিক কবরস্থানে লাশ দাফনে বাধা দেয়। তারা লাশ পাঠিয়ে দিতে চায় যার মাধ্যমে গৃহকর্মীর কাজে গিয়েছিল মৌসুমী, সেই পুলিশের এসআই মাসুদ রানার বাড়িতে। লাশ দাফনে রাত ১০টা পর্যন্ত গ্রামবাসী এবং জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে প্রথম দফার আলোচনা কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। এরপর ফের আলোচনায় বসেন সমাজপতি এবং জনপ্রতিনিধিরা। আলোচনা চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। সিদ্ধান্ত আসে স্থানীয় কবরস্থানেই দাফন করা হবে মৌসুমীকে। রাত ১টার দিকে শেষ হয় দাফনকাজ।

রাজধানীর রমনায় পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি) আবু হাসান মুহাম্মদ তারিকের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত মৌসুমী আক্তার। গত বুধবার বাসা থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মৌসুমীর বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ঘাটাইল সদর ইউনিয়নের বাইচাইল গ্রামে। মায়ের অভিযোগ, তার মেয়েকে হত্যা করা হয়েছে।

হতদরিদ্র মৌসুমীর মায়ের অভাবের সংসার। সম্বল দুই শতাংশ জমির ওপর একটি কুঁড়েঘর। দেখতে অনেকটা পল্লীকবি জসীম উদদীনের সেই আসমানীর ঘরের মতো। টিনের চালার ছোট্ট ঘরের বেড়া পলিথিনের। আজ শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সেই ঘরে বসে আছেন মেয়েহারা ফরিদা বেগম (৪৪)। চেয়ে আছেন অপলক। তার দৃষ্টিতে রাজ্যের নৈরাশ্য। শুকিয়ে গেছে চোখের জল। গলা তার ভারী।

ফরিদা বেগম জানান, দুই মেয়ে এক ছেলে রেখে মৌসুমীর বাবা মুক্তার মিয়া মারা গেছেন সাত বছর হলো। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে তিন সন্তানকে বড় করেছেন তিনি। বছর তিনেক আগে তাদের পাশের গ্রামে দড়িচৈথট্রের পুলিশের উপপরিদর্শক মাসুদ রানা বাড়িতে এসে মৌসুমীকে অনেকটা জোর করেই গৃহকর্মীর কাজে ঢাকায় নিয়ে যান। এরপর থেকে মৌসুমীকে কখনও বাড়ি যেতে দেওয়া হয়নি। ফলে মা-মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগও হয়নি। অবেশেষে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গে যখন এলেন ফরিদা, প্রিয় সন্তানের নিথর দেহ পেলেন!

তিনি জানান, প্রথম দুই-তিন মাস মাসুদের মাধ্যমে কিছু টাকা পান তারা। এরপর থেকে টাকা চাইলে উল্টো বিভিন্ন ধরনে ভয় দেখান মাসুদ।

ফরিদা বেগম আরও জানান, কয়েকমাস আগে মাসুদ তাকে বলেছেন মৌসুমীর বেতনের এক লাখ ৮০ হাজার টাকা তার কাছে। সেই টাকা দিয়ে তাদের বিল্ডিং করে দেবেন। ‘বিল্ডিং’ শব্দটা উচ্চারণ করতেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন ফরিদা। বিলাপ করে বলেন, ‘আমার দালান দরকার নাই, টেহার দরকার নাই, আমার মারে আমার বুকে ফিরাইয়া দেন। আমার মেয়াডারে অরা মাইরা হালাইছে। গরিবেরে দয়া করে নাই। আমি দয়া চাইছি আমারে দয়া করে নাই।’

স্থানীয়রা জানান, এখন পর্যন্ত মাসুদ রানা সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেও মৌসুমীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেননি।

মৌসুমীর দুলাভাই আল আমিন (২৭) বলেন, ‘ওই বাসায় অবশ্যই সিসি ক্যামেরা আছে। কী ঘটেছিল তা অবশ্যই ওই ক্যামেরায় আছে।’ তিনি জানান, তাদের পরিবারের কারো অনুমতি না নিয়ে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে।

মৌসুমীর পরিবারের সদস্যদের সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশের সেই উপপরিদর্শক মাসুদ রানা বলেন, ‘ওই পরিবারের কোনো সদস্যের টাকা তার হাতে নেই। মৌসুমী তার বেতনের টাকা তার নিজের কাছেই রাখত।’

জোর করে কাজে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘জোর করে নয়, মৌসুমী নিজের ইচ্ছাতেই কাজে গিয়েছিল।’

ঘাটাইল থানার ওসি আজহারুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার রাতেই সামাজিক কবরস্থানে সুষ্ঠুভাবে মৌসুমীর দাফন সম্পন্ন হয়েছে।’

আরো পড়ুন : ওবায়দুল কাদেরকে ১৯৭৪ সালের কথা মনে করিয়ে দিলেন মির্জা ফখরুল

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *