কুমিল্লার চান্দিনার প্রত্যন্ত গ্রাম তীর চর। সেই গ্রামের ছেলে শরীফ। তার বাবা মিজানুর পেশায় কৃষক। বছর সাতেক আগে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক বছর ধরে তিনি বিছানায়। দারিদ্র্যের কশাঘাতে শরীফ একপর্যায়ে লেখাপড়া ছেড়ে কাজে লেগে যায়। কিন্তু তার যে আয়, তা দিয়ে আর সংসার চলে না। খাবার জুটলে বাবার ওষুধ জোটে না। একটা হলে আরেকটা হয় না। বাবার বিষণ্ন মুখ, মায়ের জীবনসংগ্রাম-এসব দেখতে দেখতে হতাশ কিশোর শরীফ সিদ্ধান্ত নেয়, সে ঢাকা যাবে। খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারে, তার গ্রামের আবুল কাশেম নামের এক লোক ঢাকায় থাকেন। হোটেলে কাজ করেন। অনেক অনুরোধের পর কাশেম শরীফকে ঢাকায় আনতে রাজি হন। মাত্র ১৫ দিন আগে কাশেমের হাত ধরে সে চকবাজারের বরিশাল হোটেলে কাজে যোগ দেয়। সারা দিন হোটেলের মেছিয়ারি করে সে পেত মাত্র ২০০ টাকা। এই টাকা সে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিত। তা দিয়ে কেনা হতো বাবার ওষুধ।
গতকাল সোমবার দুপুরে বরিশাল হোটেলে আগুন লাগার খবর পান শরীফের মা ফাহিমা। একমাত্র ছেলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ার পর পাগলপ্রায় তিনি। শরীফের খোঁজে ঢাকায় আসেন খালা নাসরিন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার সময় পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে গিয়ে কিশোর শরীফের পুড়ে যাওয়া মরদেহ দেখে আঁতকে ওঠেন। চেনার উপায় নেই। নাসরিন তখন শুধু ‘ও শরীফ’, ‘ও শরীফ’ বলে চিৎকার করছিলেন।
গতকাল বরিশাল হোটেলের আগুনে পুড়ে কেবল শরীফ মরেনি, তার মতো আরও পাঁচ শ্রমিকের জীবনযুদ্ধ থেমে গেছে। যাঁরা মা–বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের মুখে তিন বেলা ডাল-ভাত জোটানো, সবাইকে একটু ভালো রাখায় আশায় ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁরা হোটেলটিতে কাজ করতেন দুই পালায়। থাকতেন হোটেল ঘরটির ওপরের দিকে কাঠের পাটাতন দিয়ে তৈরি বিশ্রামাগারে। গতকাল সকাল ১১টায় পালার কাজ শেষে বিশ্রাম নিতে শরীফসহ অন্যরা সেই বিশ্রামাগারে ছিলেন। দুপুর ১২টার কিছু সময় আগে হোটেলে আগুন ধরে যায়। আগুন নেভানোর পর পাটাতন থেকে একে একে ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন।
চকবাজারের কামালবাগের দেবীদাস ঘাট লেনের যে তিনতলা ভবনে বরিশাল হোটেলটি, সেই ভবনটির মালিক আলম মিয়া। তিনি মারা যাওয়ার পর বাড়ির দেখভাল করেন তাঁর ছেলে মো. রানা। আবাসিক এলাকার মধ্যে ভবনের অবস্থান হলেও ভবনটি পুরোপুরি কারখানা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বরিশাল হোটেলটির অবস্থান ভবনের নিচতলায় উত্তর পাশে। হোটেলটির মালিক ফখর উদ্দিন। হোটেলে শ্রমিক ছিলেন ১০ থেকে ১৫ জন। পালা করে তাঁরা কাজ করতেন। যাঁরা রাত ১১টায় কাজ শুরু করতেন, তাঁদের কাজ শেষ হতো পরদিন বেলা ১১টায়। অর্থাৎ শ্রম আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রত্যেক হোটেলশ্রমিককে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো। কাউকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি। কাজে গাফিলতির সুযোগে যখন-তখন হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হতো। ১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করেও বয়স্কদের দিনে আয় মাত্র ৫০০ টাকা। মাসে ১৫ হাজার টাকা। আর কিশোরদের দেওয়া হতো দিনে ২০০ টাকা। মাসে ছয় হাজার টাকা। এই আয় দিয়ে ঢাকায় বাসাভাড়া করে চলা অসম্ভব। তাই বেশির ভাগ শ্রমিক কাজ শেষে হোটেলেই থাকতেন।
শ্রমিকদের থাকার জন্য মালিক হোটেলের ওপরে কাঠের পাটাতন বানিয়ে দেন। সেখানে উঠতে হয় হোটেলের বাইরের ছোট্ট গলি দিয়ে লোহার সিঁড়ি বেয়ে। বিশ্রামাগার নামের এই পাটাতনের নিচে ছিল রান্নাঘর। সেখানে দিনরাত মাছ, মাংস, ভাত রান্না হতো। অন্যদিকে হোটেলের সামনের অংশে রুটি-পরোটা তৈরি হয়।
মঙ্গলবার বিকেল পাঁচটার দিকে আগুনে পোড়া বরিশাল হোটেলের সামনে শতাধিক মানুষের ভিড় ছিল। সবার চোখেমুখে ছিল শোকের ছায়া। মোবারক হোসেন নামের একজন হোটেলের ভেতর উঁকি মেরে দেখেন, পুড়ে যাওয়া লুঙ্গির কিছু অংশ। তখন তিনি বলে ওঠেন, ‘আহারে! এটা কার লুঙ্গি, কে জানে?’ বরিশাল হোটেলের পাশেই সেলিম উদ্দিনের মুদিদোকান। গতকাল আগুন লাগার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি দেখতে পান, বরিশাল হোটেলের সামনে আগুনের লেলিহান শিখা। তখন হোটেলের মালিক ফখর উদ্দিনকে টাকা রাখার বাক্স দোকান থেকে রাস্তায় নামাতে দেখেন। তখনো ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছাননি। সেলিম উদ্দিন বলেন, দোকানের কর্মচারীরা যে ওপরে আটকা পড়েছিল, সেই কথা মালিক কাউকে বলেননি কিংবা চিৎকারও দেননি।
হোটেলের ওপরের অংশে শ্রমিকেরা কাঠের যে পাটাতনে ঘুমিয়ে ছিলেন, তার বেশির ভাগ অংশ পুড়ে ছাই। পাটাতনে ওঠার লোহার সিঁড়ির কাছেই জুতার সোল তৈরির কারখানা। স্থানীয় লোকজন এটিকে ‘ফোম ফ্যাক্টরি’ বলে থাকেন। আগুনে সেখানকার সবকিছুও পুড়েছে।
একই রকম ঘটনা বারবা, মর্মান্তিক সব মৃত্যুর ঘটনা; তবু কর্তৃপক্ষের যেন টনক নড়ছে না। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে এই পুরোনো ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন দুই শতাধিক মানুষ। এক যুগ আগে ২০১০ সালে নিমতলীতে আগুনে পুড়ে ১২৪ জন মানুষের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছরের মাথায় (২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি) চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে মারা যান আরও ৭৭ জন। এর দুই বছর পর আরমানিটোলায় হাজি মুসা ম্যানশন নামের একটি ভবনের নিচতলার রাসায়নিক দোকান থেকে আগুন লেগে মারা যান চারজন।
এসব মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে ফলাও করে ছাপা হয়। কর্তৃপক্ষের লোকজন ঘটনাস্থলে জড়ো হন। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মানুষটির পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনাও দেন। কর্তৃপক্ষের লোকজন জানিয়ে দেন, ভবনে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ ছিল, সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত। কতবার কর্তৃপক্ষ বলেছে, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিতে হবে! বাস্তবে কি রাসায়নিক গুদাম সরেছে? অবশ্য বরিশাল হোটেলের আগুনের ঘটনায় কর্তৃপক্ষ বলে দিয়েছে, আগুনের সূত্রপাত হোটেলের রান্নাঘর থেকে।
চকবাজারসহ পুরান ঢাকার অধিকাংশ আবাসিক এলাকায় ছোট শত শত কারখানা। এসব কারখানায় নেই অগ্নিনির্বাপণের কোনো যন্ত্র। যত্রতত্র বিদ্যুতের তার ঝুলছে।
পুরান ঢাকায় এক যুগে এসব অগ্নিকাণ্ডে যাঁদের মৃত্যু হলো, এর দায় কেউ নেয়নি, কারও সাজা হয়নি। নিমতলীর ঘটনায় কাউকে বিচারের মুখোমুখিও করা হয়নি। শুধু একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। তবে চুড়িহাট্টা কিংবা আরমানিটোলার বেলায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। চুড়িহাট্টার ঘটনায় আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে বিচার এখনো শুরু হয়নি।
অবশ্য বরিশাল হোটেলের আগুনের ঘটনায় হোটেলমালিক ফখর উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ পুলিশ তাঁকে এক দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। তবে ভবনমালিক রানা পলাতক।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুরান ঢাকায় এমন রানা কিংবা ফখর উদ্দিন আছেন আরও অনেকে। আগেই কর্তৃপক্ষের লোকজন যদি দেখতেন, খোঁজ নিতেন যে একটি হোটেলে উচ্চ তাপে দিনরাত রান্না হচ্ছে, ঠিক তার ওপরে কাঠের পাটাতনে শ্রমিকেরা কীভাবে ঘুমান! এমন মৃত্যুকূপ যাঁরা বানিয়ে রেখেছেন, তাঁদের চিহ্নিত করা কিংবা খুঁজে বের করা অসম্ভব কোনো কাজ নয়।
বরিশাল হোটেলের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া আবদুল ওহাবের বড় ভাই আবদুল ওয়াহিদ বলেন, ‘আমরা স্যার গরিব মানুষ। গ্রামে কাজ নেই। আয় নেই। দুটো পয়সা রোজগারের আশায় ঢাকায় থাকি। অনেক কষ্ট করে থাকি, তবু যদি আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। আমার ভাই ভাগ্য পরিবর্তন করতে ঢাকায় এসে আজ আগুনে পুড়ে হেরে গেল? এর দায় কি আমাদের নেই?’