নিজস্ব প্রতিবেদক: ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সোমবার রাজধানী ঢাকায় দিনভর বৃষ্টি হয়েছে। সন্ধ্যার পর বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ে, ছিল ঝোড়ো হাওয়াও। টানা বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয় জলজট। ফলে গাড়ি চলে থেমে থেমে। অনেক এলাকার প্রধান সড়কসহ ও অলিগলি তলিয়ে যায়। ফলে ওইসব এলাকার দোকানপাট ও বাসাবাড়ির ভেতরেও পানি ঢুকে পড়ে।
বৃষ্টির কারণে সোমবার সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। এতে সকালের দিকে ভোগান্তিতে পড়েন কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থীসহ তাদের অভিভাবকেরা। সড়কে সংকট ছিল রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশারও। এই সুযোগে বাড়তি ভাড়া নিয়েছেন অধিকাংশ চালক। বিকেলে সড়কে জমা পানি আরও বেড়ে যাওয়ায় অফিস ছুটির পরে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ফলে কোথাও কোথাও দীর্ঘ সময় সড়কে আটকে থাকতে হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপপরিচালক ছানাউল হক মণ্ডল সোমবার রাত আটটার দিকে মুঠোফোনে বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীতে ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবারও সারা দিন বৃষ্টি হতে পারে। তবে দুপুরের পরে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সরেজমিনে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির আওতাধীন অন্তত ২৭টি এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। কিছু এলাকায় পানি ছিল হাঁটুসমান। সেই পানি ঢুকে পড়েছে দোকান ও বাসাবাড়িতে। অনেক এলাকার বাসিন্দাদের অনেকটা গৃহবন্দী হয়ে থাকতে হয়েছে। পানির কারণে অনেক ব্যবসায়ী দুপুরের পরে দোকান বন্ধ করে দেন।
দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির (ডিএসসিসি) আওতাধীন পুরান ঢাকার বংশাল ও নাজিরা বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার রাস্তায় হাঁটুসমান পানি জমেছে। পানি ঢুকেছে বাসাবাড়ি ও দোকানে। পানির কারণে বাসিন্দারা বাইরে বের হতে পারছিলেন না। মালপত্র নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিচ্ছিলেন কোনো কোনো দোকানের মালিক। কেউ কেউ দুপুরের পরেই দোকান বন্ধ করে দেন।
বংশালের সামসাবাদ এলাকার একটি ভবনের মালিক ইমরান হোসেন বলেন, নিচতলায় পানি উঠেছে। ঘরের বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। সময় যত যাচ্ছে, পানি বাড়ছে।
এ ছাড়া সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালসংলগ্ন পাম্পের গলি, জুরাইনের আলমবাগ ও মেডিকেল রোড, গেন্ডারিয়ার ঢালকানগর, মানিকনগরের মিয়াজান গলি, মুগদার প্রধান সড়ক, মেরাদিয়ার নবীনবাগ, শাহজাহানপুরের বেনজির বাগান এলাকা, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড (দক্ষিণ অংশ) ও হাজারীবাগ এলাকার রাস্তাঘাটেও প্রায় হাঁটুসমান পানি জমে ছিল।
পূর্ব জুরাইন এলাকার বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, ইসলামাবাদ জামে মসজিদের ভেতরে পানি ঢুকেছে। ঋষিপাড়া এলাকায় কয়েকটি সড়ক পানিতে তলিয়ে আছে। মানুষ অনেকটা ঘরবন্দী হয়ে আছে।
বৃষ্টির কারণে দুপুরের দিকেই কাঁঠালবাগানের পুরোনো গ্যাস্ট্রোলিভার গলিতে পানি জমে যায়। এ গলির বাসিন্দা প্রদীপ সরকার বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কাজের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন, রাস্তায় পানি জমেছে। পরে বিকল্প পথ ঘুরে কাঁঠালবাগান বাজার হয়ে পান্থপথে যান তিনি। রাত ৯টার দিকে কাঁঠালবাগান বাজারের রাস্তাতেও হাঁটুসমান পানি জমেছিল বলে জানান তিনি।
মো. মাসুদ রানা নামের একজন প্রাইভেট কার চালক জানান, রাত নয়টার দিকে ফকিরাপুল মোড় থেকে নটর ডেম কলেজ পর্যন্ত সড়ক দুই থেকে আড়াই ফুট পানিতে তলিয়ে ছিল। তখন ওই রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ ছিল।
দক্ষিণ সিটির পরিবেশ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের বলেন, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান ও গ্রিন রোড এলাকার পানি হাতিরঝিলের পশ্চিম পাশের স্লুইসগেট নিয়ে নিষ্কাশিত হয়। কিন্তু ওই গেট বন্ধ ছিল। পরে হাতিরঝিল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ওই গেট খোলা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে। এ ছাড়া বংশাল এলাকায় নালা সংস্কারের কাজ চলমান থাকায় সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটির (ডিএনসিসি) আওতাধীন ফার্মগেটের পূর্ব রাজাবাজার এলাকা, গ্রিন রোড উত্তর সিটি অংশ, মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ইসিবি চত্বর, মাটিকাটা, বিমানবন্দর সড়ক, তুরাগ, হরিরামপুর, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে জলজটের সৃষ্টি হয়।
সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। এতে বিকেলে অফিস ছুটির পর থেকে সড়কগুলোতে দীর্ঘ যানজট লাগে। সন্ধ্যায় ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের তথ্য জানান ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
সন্ধ্যায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে জলাবদ্ধতা হয়েছে। রাস্তা পানিতে ডুবে থাকায় যানবাহন চলতে পারছে না। তীব্র যানজটের কারণে ওই সড়কে অচলাবস্থা তৈরি হয়। বিমানবন্দর এলাকা থেকে যানজটে আটকে থাকা গাড়ির সারি চলে আসে বনানী এলাকা পর্যন্ত।
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নাবিদ কামাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে জানান, খিলক্ষেতের লা মেরিডিয়ান হোটেলের পর থেকে উত্তরায় র্যাব-১–এর কার্যালয়ের সামনে পর্যন্ত সড়ক বৃষ্টির পানিতে ডুবে গেছে। দুপুর থেকে সেচযন্ত্রের মাধ্যমে পানি অপসারণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে বৃষ্টি পড়তে থাকায় ওই উদ্যোগে কাজ হচ্ছে না। রাত সোয়া নয়টার দিকে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ওই সড়কে তীব্র যানজট ছিল।
সন্ধ্যা ছয়টার দিকে মিরপুরের ইসিবি চত্বর এলাকায় প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা বাসে আটকে ছিলেন সরকারি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাজেদা আক্তার। তিনি মুঠোফোনে জানান, ‘বাস একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল। কী হয়েছে প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না। পরে ইসিবি চত্বরের দিকে যাওয়ার পর দেখি, রাস্তায় বৃষ্টির পানি। ওই সড়কে যান চলতে সমস্যা হচ্ছে।’
ঢাকা উত্তর সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন বলেন, ১০টি অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দূর করতে সকাল থেকে ভ্রাম্যমাণ দল কাজ করছে। প্রধান সড়কগুলোতে সারা দিন যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়নি। তিনি বলেন, সন্ধ্যায় বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় ও টানা বৃষ্টি হওয়ায় পানি নামতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে ভ্রাম্যমাণ দলগুলো সার্বক্ষণিক কাজ করছে, রাতেও কাজ করবে।
আরো পড়ুন : ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে সারা দেশে এ পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু