মুকুটহীন সম্রাট আর বলা যাবে না মেসিকে। সৃষ্টিকর্তা তাকে দুই হাত ভরে দিয়েছেন। কী নেই তার হাতে। আগেই ফুটবলের সব পুরস্কার ঝুলিতে পুরে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল, শুধু বাকি ছিল বিশ্বকাপ, সেটিও পেয়ে গেলেন। ফুটবল দুনিয়ার সর্বোচ্চ চূড়ায় চলে গেলেন মেসি। আর কী পেতে চান। সবই তো পেলেন। তার চেয়ে সুখী ফুটবলার কে আছেন। ফুটবলের রাজপুত্র মেসি আর্জেন্টিনার ৩৮ বছরের খরা ঘুচিয়েছেন।
৮৬ বিশ্বকাপ জয়ের পর যখন আরেকটি বিশ্বকাপের অভিযানে নেমে ছিলেন মারাদোনা, আর্জেন্টিনা, তখন তো মেসির জন্মই হয়নি। মেসি যখন জন্ম থেকে শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন, তখনই বা কে জানত এই মেসিই একদিন বিশ্বকাপের তৃতীয় ট্রফিটা এনে দেবেন। তার জন্য তিন যুগ অপেক্ষা করতে হবে। ২০২২ সালে এসে ২২তম বিশ্বকাপের আসরে আর্জেন্টিনা আরেকটি স্বপ্নপূরণ করল। মেসির হাতে স্বপ্ন পূরণ হলো। ফুটবলের রাজপুত্র মেসি এখন আর্জেন্টিনায়। ঘরের মাটিতে। মারাদোনা বেঁচে থাকলে তিনিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। মারাদোনা মনেপ্রাণে চাইতেন মেসির হাতে ট্রফি উঠবে। অসময়ে না চলে গেলে মারাদোনা থাকতেন দোহায়, ফাইনালে। মেসিও হয়তো ট্রফিটা মারাদোনার হাতেই তুলে দিতেন। মেসিকে কাঁধে তুলে নিতেন। মারাদোনার কোচিংয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন মেসি। ভাগ্য ভালো ছিল না, সেবার ট্রফি দিতে পারেননি, মেসি। এমন সময় মেসি ট্রফি আনলেন যখন মারাদোনা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তারপরও মারাদানোকে যেভাবে আজেন্টাইনরা শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন তাতে মনে হবে এখনো মারাদোনা বেঁচে আছেন। সবার মধ্যেই বেঁচে আছেন। প্রতিটা ম্যাচের দিন মারাদোনার ছবি স্টেডিয়ামে দেখা গেছে। মারাদোনার ছবি লাগানো গেঞ্জি গায়ে দর্শক এসেছেন কাতারে। গোল করলে মেসি আকাশে তাকিয়েছেন। আর্জেন্টাইনরা বলছেন, মেসি আকাশে দিয়েগো মারাদোনোর দিকে তাকাতেন। সে-ই এবার মেসির কোচ ছিলেন।
বিশ্বকাপের সাত ম্যাচের লড়াই। সাত ম্যাচেই স্বপ্নের ফুটবলটাই খেলেছেন মেসি। যারা মেসিকে শুরু থেকে দেখে আসছেন তারাও বলেছেন, দোহার মাটিতে মেসির এমন খেলা আগে দেখা যায়নি। সাত ম্যাচের লড়াইয়ে গ্রুপ পর্বে পোল্যান্ড ছাড়া সব ম্যাচে গোল করেছেন। গোল করিয়েছেন। তার একক খেলা এবার ফুটবল দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
মেসির দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে ট্রফি জয় করে আর্জেন্টিনা রাতভর আনন্দ করেছে। লুসাইল স্টেডিয়াম থেকে ট্রফি নিয়ে ছাদখোলা বাসে বেড়িয়েছিল আর্জেন্টিনা। মেসিরা ছাদখোলা বাসে ট্রফি নিয়ে সড়ক প্রদক্ষিণ করেছে। স্টেডিয়ামের বাইরে খেলার আগে থেকেই লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল খেলার মাঠে ঢুকতে না পারুক মাঠের আশপাশে অবস্থান করাটাও যেন স্মৃতি হয়ে থাকা। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দেশ সাধারণত এমনটা করে না। নিজ দেশে গিয়ে ছাদখোলা বাসে সম্মান দেওয়া হয়। তবে এবার কাতার বিশ্বকাপের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।
১৯৭৮ এবং ১৯৮৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা বছরের পর বছর কাটিয়েছে আরেকটি ট্রফির জন্য। এবার তাদের কপাল খুলেছে। কোপা আমেরিকা জয় করার পর বিশ্বকাপও জয় করল। শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনাল খেলেছে ফ্রান্সের বিপক্ষে। ফাইনালের ৭০ মিনিট পর্যন্ত পুরো ম্যাচের দখল নিয়ে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনার জালে দুই গোল ফিরিয়ে দেয় ফ্রান্স। অতিরিক্ত ৩০ মিনিটে লড়াইয়ে আবার এগিয়ে গিয়েও ম্যাচটা রাখা গেল না, ৩-৩ গোলে শেষ হলে। পরে টাইব্রেকারে ভাগ্য নির্ধারণ হলো, ৪-৩ গোলে জিতল আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনা থেকে খবর আসছিল বুয়েন্স আয়ার্সে এই বিজয় উল্লাসের। রাস্তায় নেমে এসেছে লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের আর্জেন্টাইন ভক্তরাও রাস্তায় নেমে এসে আনন্দ করেছে। তার খবর সবই মেসিদের বেসক্যাম্পে গেছে।
আর্জেন্টিনা তাদের বেসক্যাম্প করেছিল কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাতে সেখানে গিয়ে কেউ ঘুমাননি। সংবাদ মাধ্যম গিয়েছিল ছবি তুলবে। টিভির পর্দায় দেখাবেন সরাসরি। কিন্তু বেসক্যাম্পের ভেতরে ঢোকার অনুমতি পায়নি। দূর থেকে যতটুকু দেখানো যায়। আর্জেন্টাইন সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, সারারাত জেগে কাটিয়েছেন ফুটবলাররা, সঙ্গে তাদের পরিবারও ছিল। রাতে ঘুমাতে যাননি আলভারেজ, ডি পল, মার্টিনেজ, ডি মারিয়া, তাগিলিফিকো, মলিনা, দিয়াবালা, রোমেরো, ওতামেন্ডি, মেসিরা ক্লান্ত থাকলেও বিশ্বকাপ জয়ের রাতে কার চোখে ঘুম আসবে। বেলা ১১টায় দোহা ছাড়ে। হামাদ বিমানবন্দর থেকে দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে মেসিদের ফ্লাইট। বেলা ১১টায় আকাশের পথে উড়াল দেয়। ইতালির রোমে এক ঘণ্টার ট্রানজিট। সেখানে থেকে বুয়েন্স আইরিসে। আর্জেন্টিনার সময়ে রাত ২টায় নামবে। আর বাংলাদেশ সময় আজ দুপুরের আগেই নামবে আর্জেন্টিনা।
আরো পড়ুন : এবার বিএনপির শাসনামলে নিখোঁজ, গুম ও হত্যার তালিকা হচ্ছে