সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ব্রিটিশ উপনিবেশের আধিপত্যের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষকে যে সংগ্রাম করতে হয়েছে, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীনতা এলো, সেটা যে প্রকৃত স্বাধীনতা নয়, তা বুঝতে মানুষের বিলম্ব ঘটেনি। প্রথম কারণ, স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, যার পেছনে ব্রিটিশদের উসকানি এবং সামনে ছিল প্রতিষ্ঠিত হিন্দু মধ্যবিত্তের সঙ্গে উদীয়মান মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বার্থগত দ্বন্দ্ব। স্বাধীন বঙ্গকে ভাগ করে ফেলল, দাঙ্গায় মানুষ প্রাণ দিল, কিন্তু স্বাধীনতা যে মুক্তি আনতে পারবে বলে আশা করা হয়েছিল, সেটা আর দেখা গেল না। পূর্ববঙ্গের মানুষের জন্য স্বাধীনতা যে অর্থবহ হয়নি, তার প্রমাণ তো বঙ্গভঙ্গ, সেই সঙ্গে যে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ও শোষণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা আগে ছিল তাতে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। স্বাধীনতার অর্থ দাঁড়াল ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তাতে লাভবান হলো পশ্চিম পাকিস্তানিরা, বিশেষভাবে তাদের বেসামরিক ও সামরিক আমলাতন্ত্র এবং ব্যাবসায়িক মহল। দুর্বৃত্তকে তারা একটি ঔপনিবেশিকে পরিণত করতে চেয়েছিল। সেটা পরিষ্কারভাবে বোঝা গেল, যখন উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা এলো। পূর্ববঙ্গের মানুষ টের পেল, তাদের চিরকালের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার ব্যবস্থা চলছে। অন্যদিকে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে ভ্রান্ত ছিল, সেটা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের নবগঠিত গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বাঙালি মুসলমান দেখতে পেল তার বাঙালি সত্তা বিলীন হয়ে যাবে এবং উপলব্ধি করল যে দ্বিজাতিতত্ত্ব ভ্রান্ত।
’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি অহিংস অভ্যুত্থান। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করা হলো, অন্যদিকে তেমনি পাকিস্তান শাসকেরা যে নতুন ঔপনিবেশিক শোষণব্যবস্থা পূর্ববঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, তার বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের প্রতিরোধের লক্ষণ পরস্ফুটি হয়ে উঠল। ১৯৫৪ সালে যে প্রাদেশিক নির্বাচন হয়, তাতে পূর্ববঙ্গবাসী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী মুসলিম লীগকে সর্বাত্মকভাবে প্রত্যাখ্যান করে। এটা ছিল পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে রায়। এই রায়কে মুছে ফেলার জন্য তখন কেন্দ্রীয় সরকার তাদের শাসন জারি করে এবং আরও পরে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন কায়েম হয়। এই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গবাসী প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলনে নেমেছে এবং আন্দোলনের একপর্যায়ে ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। এই অভ্যুত্থান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরই পরিণতি, কিন্তু এর মাত্রা ছিল ভিন্ন ধরনের। এটা ছিল সমগ্র জনগণের একটি অবস্থান। এর অভ্যন্তরে যে বোধটা ছিল, সেটি কেবল স্বায়ত্তশাসন নয়, এটি সামাজিক বিপ্লবেরও। এই অভ্যুত্থানের চেতনাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের পতন ঘটে এবং সেখানে ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন চলে আসে। বিক্ষুব্ধ মানুষকে শান্ত করার জন্য আইয়ুব খান প্রতিষ্ঠিত ব্যারিট (সংখ্যা সাম্য) ভেঙে দিতে সক্ষম হয় এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবি মেনে নেয়। এই ভোটাধিকার আগে স্বীকৃত হয়নি। ব্রিটিশ আমলে নয়, পাকিস্তান আমলেও হতো না, যদি না পূর্ববঙ্গের অভ্যুত্থান হতো। ইয়াহিয়া খান জনবিক্ষোভকে স্তিমিত করার জন্য দ্রুত নির্বাচন দেন; কিন্তু সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের মানুষ যে রায়টি ঘোষণা করে, সেটি স্বায়ত্তশাসন নয়, পূর্ণ স্বাধীনতার। এই রায়কে দরকষাকষি বা দল ভাঙাভাঙির মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় করা যাবে না—এটা টের পেয়ে পাকিস্তানি শাসকেরা সেনাবাহিনীকে পূর্ববঙ্গে গণহত্যায় নামিয়ে দেয়। এই গণহত্যা প্রতিরোধ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। এই যুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য ছিল না, এ ছিল অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যও।
আমরা যাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলি, আসলে এটা সমাজবিপ্লবের চেতনা। কেননা, শোষণভিত্তিক সমাজকাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না আনলে মুক্তি অসম্ভব। সমাজের সব শ্রেণির মানুষ ঐ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। সেটা ছিল একটি সমষ্টিগত স্বপ্ন। কিন্তু স্বাধীনতার পরে মুক্তির এই সমষ্টিগত স্বপ্ন আর অক্ষত থাকেনি। সেটা ভেঙে পড়েছে। ব্যক্তিগত উন্নতির স্বপ্নই প্রধান হয়ে উঠেছে। সে জন্য সমষ্টিগত মুক্তি অর্জিত হয়নি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানা ধরনের ব্যাধি দেখা দিয়েছে। এই ব্যাধিগুলো আগেও ছিল, তবে এত প্রকট আকারে প্রকাশ পায়নি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ঐ স্বপ্নটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি বলেই আজকে আমাদের জীবন নিরাপত্তাহীন, বিপদসংকুল হয়ে পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের আর পরিচালিত করতে পারছে না। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রধান শত্রু। যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, তাদের কর্তব্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সমাজবিপ্লবী চেতনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করা। মুক্তিযুদ্ধ যে শেষ হয়ে যায়নি, তার একটি পর্যায় আমরা অতিক্রম করেছি মাত্র। সেই সত্যটা আজ চতুর্দিকে পরিব্যাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের বৈপ্লবিক চেতনার পক্ষে না দাঁড়ালে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে, তেমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিল, তারই পরিণতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে। অথচ সামগ্রিক অর্থে আমরা সমাজকে পরিবর্তন করতে পারিনি এবং এটাও বলে দেয় যে, আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের সমষ্টিগত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করা। এই বাস্তবায়নের পথে প্রধান কর্তব্য হচ্ছে মূল শত্রুকে চিহ্নিত করা। দ্বিতীয় কর্তব্য সেই শত্রুকে মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগোনোর পথ খুঁজে বের করা। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্র ছিল আমলাতান্ত্রিক। পাকিস্তান আমলেও রাষ্ট্রের সেই চরিত্র বদলায়নি। ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছিল মাত্র। একাত্তরের যুদ্ধ ছিল ভিন্ন ধরনের। এটি ছিল রাজনৈতিক জনযুদ্ধ। তার লক্ষ্য ’৪৭-এর মতো ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাধীনতা নয়, লক্ষ্য ছিল সার্বিক মুক্তি। এই মুক্তির জন্য কেবল পুরোনো রাষ্ট্রকে ভাঙা নয়, রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করাও ছিল অভীষ্ট। এর জন্য দরকার ছিল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ’৭১-এ রাষ্ট্র ভাঙল, কিন্তু তার মূল কাঠামোতে পরিবর্তন এলো না। সে আগের মতোই আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী রয়ে গেল। পুরোনো আইনকানুন, বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী—সবকিছু আগের মতোই রয়ে গেল।
মানুষ আশা করেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন; কিন্তু সেটা ঘটেনি। শোষণ ও নিপীড়নমূলক পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থাই কায়েম রইল। একটি শাসকশ্রেণি গড়ে উঠল, যারা পাকিস্তান আমলেও সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যাদের উন্নতির পথ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রশস্ততর হয়ে গেল। এই শ্রেণি সম্পদশালী হয়েছে এবং এরাই বিভিন্ন শাসকদলীয় নামে ও পরিচয়ে দেশ শাসন করছে। কখনো নির্বাচিত হয়ে, কখনো বিকল্প উপায়ে এরাই রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব করে। একাত্তরের পরে বাংলাদেশের রাজনীতি এই শাসকশ্রেণির মধ্যেই স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছাড়া আর কিছু নয়। জনগণ আগের মতোই শাসকদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে রইল। মুক্তিযুদ্ধে তারা যে স্বপ্ন নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিল এবং যে স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বসে ছিল, সেই স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। স্বপ্ন ছিল সমাজও বদলাবে, সমাজে বিদ্যমান ধনবৈষম্য দূর হবে এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সেটা ঘটেনি। ফলে মেহনতি মানুষ সেখানেই রয়ে গেছে, যেখানে তারা আগে ছিল। শাসকশ্রেণির লুণ্ঠন প্রবৃত্তি ও প্রক্রিয়ার দায়ভার বহন করতে গিয়ে অর্থনীতি বিকশিত হতে পারেনি। উৎপাদন যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি, বিশ্বায়নের চাপে আমাদের বাজার বিদেশি পণ্যের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মাটি ও সমুদ্রের নিচে যে সম্পদ আছে, তা-ও নিরাপদে নেই।
বিনিয়োগ সীমিত হওয়ার কারণে কর্মসংস্থান বাড়েনি, বেকারত্ব ও হতাশা বেড়েছে। গ্রামের মানুষ শহরে এসে মানবেতর জীবন যাপন করছে। বৈষম্য আগেও ছিল, কিন্তু স্বাধীনতার পরে সেই বৈষম্য বৃদ্ধির হার আগের বৃদ্ধিকে হারিয়ে দিয়েছে। বস্তুত, আমাদের স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাস বৈষম্য বৃদ্ধির ইতিহাস। ধনীরা যত ধনী হয়েছে, তত তাদের দেশপ্রেম হ্রাস পেয়েছে এবং সেই দেশপ্রেমহীন ধনীরা সাধারণ মানুষের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদ মানুষকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও আত্মস্বার্থ বৃদ্ধিতে ব্যস্ত রেখেছে। সমষ্টিগত মুক্তির কথা ভাবার অবকাশ নির্মমভাবে কমে এসেছে। পুঁজিবাদের যে সৃষ্টিশীল ভূমিকা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সেটা নেই। কারণ এখানকার ধনীরা দ্রুতগতিতে লুণ্ঠন ও শোষণের মাধ্যমে আরও ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পোশাকশিল্পের অবস্থাটা দেখলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশে এই শিল্পের বিকাশ মালিকদের মেধার কারণে ঘটেনি, ঘটেছে সস্তা শ্রমের অপর্যাপ্ত সরবরাহের কারণে। শ্রম এখানে অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা।
মুক্তির অসমাপ্ত যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা সমষ্টিগত মুক্তি অর্জন করতে পারব বলে আশা করতে পারি। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন হবে কে বা কী—তা চিহ্নিত করা। শত্রুর বিরুদ্ধে আগে যেমন আমরা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করেছি, আজও তেমনিভাবে সংগ্রাম করতে হবে। এর জন্য দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মানুষের ঐক্য চাই। জনগণের মুক্তির সংগ্রাম আগেও যেমন ছিল শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে, এখনো তেমনি থাকবে তাদের বিরুদ্ধেই। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে ত্যাগ-আত্মত্যাগে ও মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে অকল্পনীয় ত্যাগের মাধ্যমে ৫০ বছর আগে আমরা একধরনের রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করেছি; সেই অর্জনকে রাষ্ট্র ও সমাজকাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজে লাগিয়ে দৃঢ়প্রত্যয়ে সমৃদ্ধ হোক বাংলাদেশ; কাজটা কঠিন কিন্তু এর কোনো বিকল্প পথ নেই।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সুত্র: ইত্তেফাক অনলাইন
আরো পড়ুন : প্রথমবারের মতো ভার্চুয়াল ব্যাংক চালুর করতে যাচ্ছে থাইল্যান্ড