ইতালিতে থেকে আশ্রয়প্রার্থীদের কনটেইনারে ভরে ফেরত পাঠানো হচ্ছে গ্রিসে

আন্তর্জাতিক ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

গ্রিস থেকে ইতালিতে প্রবেশের সময় আশ্রয়প্রার্থীদের আটক করছে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁদের কনটেইনারে ভরে জাহাজে করে আবার গ্রিসে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এই আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারী–পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে শিশুরাও। গ্রিসে ফেরত পাঠানোর সময় জাহাজে তাঁরা চরম অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।

আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের সঙ্গে ইতালি সরকারের এমন আচরণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরার একটি যৌথ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। চলতি সপ্তাহে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরিতে আল–জাজিরার সঙ্গে কাজ করেছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান লাইটহাউস রিপোর্টসসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।

আফগানিস্তানের একজন আশ্রয়প্রার্থী বলেন, অনেকের সঙ্গে তাঁকেও একটি কনটেইনারের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। সেটি ছিল মাত্র সাড়ে ৬ ফুট লম্বা ও ৪ ফুটের মতো চওড়া। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল এক বোতল পানি। খাবারের কোনো নামগন্ধ ছিল না।

প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত, বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে বিপুলসংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের দেশগুলোতে পাড়ি জমান। এই আশ্রয়প্রার্থীরা প্রথমে ভূমধ্যসাগরের পারের দুই দেশ গ্রিস ও ইতালির তীরে গিয়ে ভেড়েন। সেখান থেকে তাঁরা ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে প্রবেশের চেষ্টা করেন, কিংবা জাতিসংঘ বা অন্য স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর সহায়তা চান।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে কথা বলা হয়েছে আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকের কয়েকজন আশ্রয়প্রার্থীর সঙ্গে। তাঁরা বলেন, গত বছরে ইতালিতে প্রবেশের সময় দেশটির ভেনিস, আনকোনা, বারি ও ব্রিনদিসি শহরে আড্রিয়াটিক সাগরের বিভিন্ন বন্দর থেকে তাঁদের আটক করা হয়েছিল। এরপর তাঁদের বাণিজ্যিক জাহাজে করে গ্রিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কয়েকটি জাহাজের কর্মীরা আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রিসে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জাহাজে বন্দী রাখার এই জায়গাগুলোকে তাঁরা বলেন ‘জেলখানা’।

যাত্রাপথে ফেরিতে নিজেদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন ওই আশ্রয়প্রার্থীরা। তাঁদের অনেকের ভাষ্যমতে, জাহাজে তাঁদের অন্ধকার ধাতব বাক্সে ও ছোট ছোট কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল। দেওয়া হতো না কোনো খাবার ও পানি। কোনো কোনো আশ্রয়প্রার্থীকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে এক দিনের বেশি সময় আটকে থাকতে হয়েছে।

এই ভুক্তভোগীদের একজন আফগানিস্তানের নাগরিক বলেন, অনেকের সঙ্গে তাঁকেও একটি কনটেইনারের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। সেটি ছিল মাত্র সাড়ে ছয় ফুট লম্বা ও চার ফুটের মতো চওড়া। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল এক বোতল পানি। খাবারের কোনো নামগন্ধ ছিল না। সব দুর্দশা মেনে নিয়ে সেখানে তাঁদের বাধ্য হয়ে থাকতে হয়েছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাহাজে অনেক আশ্রয়প্রার্থীকে ধাতব পাইপের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল। আর অনুসন্ধানে এমন তিনটি ঘটনা উঠে এসেছে, যেখানে ১৮ বছরের কম বয়সী অর্থাৎ শিশুদের গ্রিসে ফেরত পাঠানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এদিকে গ্রিস সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, গত দুই বছরে ইতালি থেকে ২৩০ জনের বেশি আশ্রয়প্রার্থীকে গ্রিসে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি বলে মনে করছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। কারণ, ফেরত পাঠানো শরণার্থীদের বিষয়ে ঠিকঠাক তথ্য সব সময় সরকারি হিসাবে নথিবদ্ধ থাকে না।

জাহাজগুলো যেন ‘জেলখানা’

আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রিসে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে গ্রিস ও ইতালির মধ্যে চলাচলকারী বেশ কয়েকটি জাহাজে ভ্রমণ করেছেন সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরা। গ্রিসগামী এমন একটি জাহাজে ধারণ করা ভিডিওতে দেখা গেছে, এককালে শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করা হতো, এমন একটি কক্ষে আশ্রয়প্রার্থীদের রাখা হয়েছে।

ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছিল ওই শৌচাগারের দরজায় থাকা চাবির ফুটো দিয়ে। ছোট একটা ক্যামেরায় করা ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, শৌচাগারটির ভেতরে ভাঙা শাওয়ার, কমোড ও মাদুর রাখা। দেয়ালে নানা ভাষায় লেখা নাম ও তারিখ। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি তৈরি করতে যেসব আশ্রয়প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল, তাঁদের বর্ণনার সঙ্গে মিল রয়েছে শৌচাগারের।

আরেকটি জাহাজের গাড়ি রাখার স্থানে কয়েকটি বাক্স থাকার তথ্য উঠে এসেছে। আটক আশ্রয়প্রার্থীরাও একই ধরনের বাক্সের কথা বলেছিলেন। এমন কয়েকটি জাহাজের কর্মীরা আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রিসে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। জাহাজে বন্দী রাখার এই জায়গাগুলোকে তাঁরা বলেন ‘জেলখানা’।

ইউরোপীয় আদালতের রায়ের লঙ্ঘন

আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে কাজ করেন আইনজীবী আমারিলডা লিসি। আল–জাজিরার যৌথ অনুসন্ধানে যেসব তথ্য–প্রমাণ হাতে এসেছে, তার সঙ্গে ইতালি থেকে ফিরিয়ে দেওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের বক্তব্যের মিল রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনিও। তিনি বলেন, ইতালি থেকে গ্রিসে ফিরিয়ে দেওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের অনেকের মুখ থেকে জাহাজে আটকে রাখার বিষয়টি শুনেছেন তিনি।

১৯৯৯ সালে ইতালি ও গ্রিসের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী, অভিবাসী ও শরণার্থী হিসেবে যাঁরা আশ্রয় নিতে চান, তাঁদের গ্রিসে ফেরত পাঠাতে পারবে ইতালি। তবে এর বাইরে রাজনীতিসহ অন্য কারণে আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানো যাবে না।

এদিকে এর আগেও ইতালিতে আশ্রয়প্রার্থীদের গ্রিসে পাঠানোর ঘটনা ঘটেছে। এমন সব ঘটনার জেরে ২০১৪ সালে ইউরোপের মানবাধিকার আদালত একটি রায় দেন। রায়ে আশ্রয়প্রার্থীদের ফেরত পাঠানোকে অবৈধ উল্লেখ করা হয়। তাই বলা চলে, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে, তা ওই রায়ের লঙ্ঘন।

আরো পড়ুন : জেনে নিন নিখোঁজ হওয়ার ৬ বছর পর হাড়গোড় পাওয়া থেকে কিভাবে জানা গেল পরিচয়

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *