হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপনের আদ্যোপান্ত নিয়ে নতুন তথ্য, মেয়েকে গলা টিপে মারার হুমকি, থানায় অভিযোগ
সিলেট ব্যুরো: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র আবুল হারিছ চৌধুরী। বিশেষ করে এক যুগের বেশি সময় ধরে বারবার শিরোনামে উঠে এসেছে তার নাম। প্রায় ১৪ বছর তিনি কোথায় ছিলেন, কীভাবেই বা ছিলেন, এ নিয়ে রহস্যের যেন কোনো কূলকিনারা ছিল না। লাপাত্তা হারিছ চৌধুরীর হদিস দিতে পারেনি কেউই। তবে জানতেন একজন, তিনি আশিক উদ্দিন চৌধুরী। তিনি হারিছ চৌধুরীর আপন চাচাতো ভাই। জোট সরকারের আমলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তিনিই হারিছ চৌধুরীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। হারিছ চৌধুরীর অন্তর্ধানের সময়ও তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তার। অবশেষে এমনটা নিজ মুখে স্বীকার করেছেন আশিক চৌধুরী। হারিছ চৌধুরীর রেখে যাওয়া একটি এতিমখানা ঘিরে পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন আশিক। দ্বন্দ্বের জেরে হারিছের মেয়ে সামিরাকে ‘গলা টিপে মারার’ হুমকি দিয়েছেন তিনি। বিষয়টি গড়িয়েছে থানা-পুলিশে।
হারিছ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দিঘিরপাড় পূর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর গ্রামে। আশিক চৌধুরী সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হারিছ ছিলেন দুর্দ- প্রতাপশালী। আলোচিত হাওয়া ভবনের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। ক্ষমতার শীর্ষে থেকে তখন ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন বলে অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিএনপি-জামায়াতের বিদায় আর ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আগমনে বদলে যায় হারিছ চৌধুরীর দাপটের দৃশ্যপট। হাওয়া ভবনের অন্যতম অধিকর্তা তখন নিজেই হাওয়া হয়ে যান! এর পর থেকে শুধু গুঞ্জন আর গুজব তাকে নিয়ে। কখনো যুক্তরাজ্যে, কখনো ইরানে, আবার কখনো ভারতে তাকে দেখা গেছে বলে গুঞ্জন উঠেছিল। আত্মগোপনে থাকা হারিছ চৌধুরীর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়। গত বছরের শুরুর দিকে সংবাদমাধ্যমে বেরিয়ে আসে চমকপ্রদ তথ্য। জানা যায়, হারিছ চৌধুরী দেশত্যাগ করেননি। ঢাকায় ভুয়া পরিচয়ে আত্মগোপনে ছিলেন। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। ওই সময় তার মেয়ে ব্যারিস্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফেরেন। তিনি বাবার মরদেহ দাফন করেন ঢাকার অদূরে সাভারের একটি মাদরাসা প্রাঙ্গণে। হারিছ চৌধুরীর মারা যাওয়ার বিষয়টি গত বছর শুরুর দিকে স্বীকার করেছিলেন আশিক চৌধুরী। তবে তিনি জানিয়েছিলেন, হারিছ চৌধুরী মারা গেছেন যুক্তরাজ্যে। আত্মগোপনের পর থেকে হারিছের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকার দাবি করে আসছিলেন আশিক। শেষ পর্যন্ত হারিছ চৌধুরীর মৃত্যুর প্রায় ১৭ মাস পর আশিক স্বীকার করেছেন যোগাযোগ থাকার কথা। জানা গেছে, ১৭ জানুয়ারি সকালে আশিক চৌধুরীর বাবার নামে ‘রফিকুল হক চৌধুরী স্মৃতি পরিষদ’-এর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেদিন এক অনুষ্ঠানে সামিরা চৌধুরীকে গলা টিপে মারার হুমকি দেন আশিক চৌধুরী। এ ছাড়া হারিছ চৌধুরীর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও বিষোদ্গার করেন তিনি।
জানা গেছে, ২০০৩ সালে নিজের বাবার নামে ‘শফিকুল হক চৌধুরী মেমোরিয়াল এতিমখানা’ প্রতিষ্ঠা করেন হারিছ চৌধুরী। হারিছ চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার মেয়ে সামিরা এতিমখানাটির খোঁজখবর রাখতেন। চাচা কামাল উদ্দিন চৌধুরী ও চাচাতো ভাইদের সঙ্গে এতিমখানার বিষয়ে কথাবার্তা বলেন সামিরা। এতে ক্ষুব্ধ হন আশিক চৌধুরী। তাকে পাশ কাটিয়ে অন্যদের সঙ্গে এতিমখানার বিষয়ে কথাবার্তা বলায় রেগে যান তিনি। আশিক চৌধুরীর রাগ আর ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ১৭ জানুয়ারি। সেদিনের আশিক চৌধুরীর বক্তব্যের ভিডিও এখন সংবাদ মাধ্যমের হাতে। ভিডিওতে দেখা যায়, আশিক উদ্দিন চৌধুরী বলছেন, ‘হারিছ চৌধুরী তো পলাতক, আমি তার সাথে থাকতাম। আমি যেতাম, আসতাম, থাকতাম, দেখতাম, চাইতাম সবই। আমার সাথে গল্প করতেন…।’ তাকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি হারিছ চৌধুরীর চাচাতো ভাই। হারিছ চৌধুরী পলাতক ১১-১২ বছর, প্রহরা দিলাম আমি। একবারও (হারিছ) জিজ্ঞেস করেননি, ওর ছেলে কি ভালো আছে? ও কি ভালো আছে? ঘুরেফিরে তার (হারিছ) সেই মায়ার মানুষদের কথাই জিজ্ঞেস করতেন…।’
হারিছ চৌধুরী আত্মগোপনে থাকাকালীন তার সঙ্গে আশিক চৌধুরীর যোগাযোগের বিষয়টি এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। এদিকে ওই অনুষ্ঠানে এতিমখানা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এতিমখানা টিকিয়ে রাখতে আমার যত শক্তি নিয়োগ করা লাগে আমি করব!’ একপর্যায়ে আশিক চৌধুরী বলেন, ‘হারিছ চৌধুরীর কম বয়সী মেয়ে আসছে। তাকে চ্যানেলে চ্যানেলে নেওয়া হচ্ছে। গলা টিপে ধরে হারিছ চৌধুরীর মেয়েকে মেরে ফেলব। আমি তার মায়ের জামাই, আমি তার বাপ… আজ বাবা দুনিয়ায় নেই, আমি তার বাবা… ধৈর্য অনেক ধরেছি, গলা টিপে ধরব। আর আমার বাড়িতে ঢুকবে কানাকানি করার জন্য, মারতে মারতে বাড়ি থেকে বের করে দেব। তোমরা রেডি থেকো গল্লাটল্লা নিয়ে, মারতে মারতে বের করে দেব।’
এদিকে আশিক চৌধুরীর গালাগাল ও হুমকির বিষয়ে সোমবার রাতে কানাইঘাট থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন হারিছ চৌধুরীর আপন ভাই কামাল চৌধুরীর ছেলে রাহাত চৌধুরী। লিখিত অভিযোগে তিনি ফৌজদারি, জননিরাপত্তা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে আশিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে অনুরোধ করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা কানাইঘাট থানার এসআই পীযূষ চন্দ্র সিংহ বলেন, ‘আমরা লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এখন সেটি তদন্ত করে দেখা হবে।’
এ প্রসঙ্গে আশিক চৌধুরীর সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন সংযোগ কেটে দেন।
আরো পড়ুন : কহর দরিয়া খ্যাত টঙ্গী তুরাগ নদ এখন মরা খাল