বেপরোয়া হিজড়াদের উৎপাতে নাজেহাল রাজধানীবাসী

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনদুর্ভোগ প্রচ্ছদ হ্যালোআড্ডা

তিন বছর পর দেশে ফেরেন হাবিবুর রহমান। তিনি দুই দশক ধরে থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। রবিবার দেশে আসার সময় পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভিন্ন উপহার নিয়ে আসেন। স্বজনরাও হাবিবুর রহমানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে এসেছিলেন। ভাড়া করা মাইক্রোবাসে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হতে টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সামনে ইউটার্ন নিয়ে বনানীমুখী সড়কে গেলেই ওত পেতে থাকা হিজড়ারা তাদের জিম্মি করে ফেলে। তিন হিজড়ার দুজন গাড়ির জানালায় গিয়ে চাঁদা চায়। আর একজন সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামিয়ে রাখে। ঘটনাটি যেখানে তার প্রায় ৫০ গজ দূরেই দাঁড়িয়ে সড়কে যানজট নিরসনে কাজ করছিলেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তবু হিজড়াদের কবল থেকে রক্ষা করতে তারা কেউ এগিয়ে আসেননি। হাবিবুর রহমানের কাছে হিজড়ারা ১ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। পরিবারের সবার সামনে তাদের অশ্লীল কথাবার্তার মুখে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ৩০০ টাকা দিয়ে তাদের বিদায় করেন তিনি।

জানা গেছে, বেপরোয়া হিজড়াদের উৎপাতে প্রবাসী ছাড়াও চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন নতুন সন্তান জন্ম দেওয়া বাবা-মা এবং বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের আজমপুর, আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী এবং হোটেল লা মেরিডিয়ানের উল্টো পাশের সড়ক, কুড়িল, কুর্মিটোলা হাসপাতালের উল্টো পাশ, কাকলি, চেয়ারম্যানবাড়ী, মহাখালী, মিরপুর-১০, টেকনিক্যাল মোড় বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হিজড়াদের দিনদুপুরে চলে চাঁদাবাজি। এসবের পেছনে কারা- খুঁজতে গিয়ে যোগাযোগ করা হয় রাজধানীর মগবাজারের স্বপ্না হিজড়ার সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, আবদুল্লাহপুর এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করে শান্তা হিজড়া, বিমানবন্দর এলাকায় শারিকা আর বনানী নিয়ন্ত্রণ করে নাখালপাড়ার ঝুমা হিজড়া। সর্দারনিরা প্রকৃত হিজড়া, কিন্তু অনুসারীরা নকল। জানা গেছে, এরা এখন বেশি বেপরোয়া। আর প্রশাসনও অজ্ঞাত কারণে এদের কিছু বলে না। হিজড়াদের মধ্যে কচি, হুররাম, রাখি ও তানিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে ৮-১০টি হিজড়া গ্রুপ চাঁদাবাজি করে। প্রতিটি গ্রুপই দিনে লাখখানেক টাকা চাঁদা ওঠায়। হিজড়া ঝুমা বলেন, ‘আমাদের চাঁদা ওঠে দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। আমরা কিছু দোকান, বিয়েবাড়ি আর নতুন বাচ্চা হলে টাকা নিই। আর বিমানবন্দর এলাকার চাঁদাবাজির পুরোটাই করে শারিকার লোকজন।’

হাবিবুর রহমানের মতো কুড়িল বিশ্বরোডে হিজড়াদের কবলে পড়েন কুয়েতপ্রবাসী আনিসুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘এক বছর ছয় মাস পর যখন মাতৃভূমিতে এলাম বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর বিশ্বরোডে একদল হিজড়া আমাদের গাড়ি লক্ষ করে সামনে দাঁড়ায়। তখন তাদের মধ্য থেকে একজন আমার কাছে এসে ২ হাজার টাকা দাবি করে। আমি গড়িমসি করায় তারা উচ্চৈঃস্বরে অশ্লীল বাক্য ছোড়ে এবং শারীরিকভাবে হেনস্তার চেষ্টা করে। এর আগে এসব বিষয়ে আমি শুনেছি, কখনো সম্মুখীন হইনি। পরিবারের সবার সামনে একপ্রকার লজ্জায় পড়ে ১ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।’

ভুক্তভোগীরা বলছেন, হয়তো বিমানবন্দরে হিজড়াদের কোনো সোর্স কাজ করে। যে কারণে প্রবাসীরা ফিরলেই এরা সড়কে সতর্ক অবস্থান নেয়। এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, ‘বিমানবন্দরে তাদের সোর্স থাকলে আমরাই আটক করতাম। হিজড়ারা এমন কিছু পয়েন্ট সিলেক্ট করে যেখানে গাড়ি স্লো হতে বাধ্য। সেসব জায়গায় তারা গাড়িতে যাত্রীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে।’ ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত হিজড়াদের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। মামলা নিচ্ছি, গ্রেফতার করছি। বিমানবন্দর সড়কে প্রবাসীদের হয়রানি বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, গাজীপুর, উত্তরা, মিরপুর-১০, টেকনিক্যাল বাস স্টপেজ, কাকলি, বনানী ফুটওভার ব্রিজ, বিজয় সরণি এলাকায় হিজড়াদের উৎপাত বেশি। বনানী চেয়ারম্যানবাড়ী এলাকায় ট্রাফিক সংকেতে যানবাহন থামার পর হিজড়ারা গাড়িতে উঠে জনে জনে টাকা দাবি করে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পথে চলাচলকারী একটি বাসে দেখা গেছে, তারা প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে টাকা চাইতে থাকে। কেউ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেই ওরা শরীর থেকে জামা খুলে ফেলে। অশোভন আচরণ করে। আর প্রাইভেটকার যাত্রীদের নানা অঙ্গভঙ্গি করে গাড়ির গ্লাস খুলতে বলে। গাড়ির গ্লাস বন্ধ করে দিলে সামনে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে যায়।

দেখা গেছে, গতকাল দুপুর ১২টায় পল্টন মোড় থেকে জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত যানজটে আটকে থাকা গাড়িগুলোয় এক এক করে উঠছে আর নামছে দুজন হিজড়া। প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে তারা চাঁদা আদায় করে। চাঁদা দিতে রাজি না হলে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মুজাহিদ আল সাফিদ বলেন, ‘বর্তমানে বিমানবন্দরের পাশে নির্মাণকাজ চলমান থাকায় দেখা যায় হিজড়ারা এ সুযোগে বিভিন্ন গাড়ি ধরে প্রবাসীদের হয়রানি করছে। আমরা এর আগেও হিজড়াদের উৎপাত বন্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। অনেকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পুলিশের সামনেই হিজড়ারা যাত্রীদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করছে।’

ডিএমপির অভিযানে থামেনি উৎপাত : হিজড়াদের লাগামহীন চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করতে গত বছরের ২০ জুন মাসিক অপরাধ সভায় কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। এ নির্দেশনা পাওয়ার পরই কঠোর অবস্থান নেওয়া শুরু করে রাজধানীর সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। পুলিশ সদর দফতরের সামনে, শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার এলাকায় উৎপাত কিছুটা কমলেও অন্যসব এলাকায় আগের মতোই আছে।

হিজড়ার বেশে মামলার আসামি : গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অভিযানে হিজড়া বানানোর একটি চক্রের চারজন গ্রেফতার হয়। চক্রের হোতা হাদিউজ্জামান। একসময় খুলনার এক চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। এ চক্রের সঙ্গে হিজড়া পরিচয়ে থাকা কচি, মরিয়ম ও সীমা নামে কয়েকজনের নাম বেরিয়ে আসে। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা পশ্চিম, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ কয়েকটি থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর মালিবাগে মাহি হাসান টাওয়ারের চতুর্থ তলায় স্ত্রীর নামে ‘লেজার বিউটি পারলার’ খুলে লিঙ্গ রূপান্তরের কারবার শুরু করেছিলেন হাদিউজ্জামান। ডিবি তার স্ত্রী সোনিয়া আক্তার, সহযোগী নুর ইসলাম ও জনি আহম্মদকে গ্রেফতার করে। এ সময় পারলারের বিশেষ একটি কক্ষে অভিযান চালিয়ে অপারেশনের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও হরমোন পরিবর্তনের ওষুধ জব্দ করা হয়।

হিজড়া সেজে চাঁদাবাজি : গণপরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চার হিজড়াকে গ্রেফতার করে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ। তারা ছিলেন মৌসুমী (৩২), অনিকা (১৯), তুলি (২৪) ও দুলি (২৫)। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এরা সবাই পুরুষ। ওই থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানিয়েছিলেন, গ্রেফতারের পর তৃতীয় লিঙ্গের চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করা হয়। এরপর জানা গেছে, তারা মূলত তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি নয়। তারা সবাই পুরুষ। তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি সেজে দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর উত্তরার বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি করত।

আরো পড়ুন : আরবি পড়তে গিয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার; আটক ৫৫ বছর বয়সী ব্যক্তি

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *