সড়কে এত মৃত্যু থামাবে কে? কীভাবে থামবে? প্রতি মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সড়কের উন্নয়ন, হাইওয়ের পুলিশ বাড়ানোসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও কেন থামানো যাচ্ছে না মৃত্যুর সংখ্যা? যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, শুধু জানুয়ারি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫৮৫ জন। এত মৃত্যুর পরও সবাই কেমন যেন নির্বিকার! আলোচিত দু-একটি ঘটনার পর হইচই শুরু হলে দুর্ঘটনা কিছুটা কমে। এরপর আবারও যা-তাই।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, দুর্ঘটনা তাকেই বলে যা কখন, কীভাবে, কোথায় ঘটবে তা মানুষ জানে না। কিন্তু যেটি আমাদের সৃষ্টি করা বা সহজে দূর করা যায় কিংবা সুনির্দিষ্ট কারণে ঘটে সেটিকে আর দুর্ঘটনা বলা যায় না, সেটি নিঃসন্দেহে হত্যাযজ্ঞ। এর জন্য সরকার কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। যখনই কোনো চালককে আটক করা হয়, দেখা যায় তার রুট পারমিট অথবা লাইসেন্স কোনো কিছু একটা নেই। অথবা লাইসেন্স থাকলেও হালকা যানের লাইসেন্স নিয়ে ভারী যান চালাচ্ছেন। এসব ব্যাপারে যারা গাফিলতি করছেন, তাদের গাফিলতি দেখার দায়িত্ব কি সরকারের নয়?
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের দেশে চালককে দায়ী করতে গিয়ে প্রকৃত দোষীরা বাইরে থাকছেন। এটা তাদের জন্য একটা পুরস্কারও বটে। কিন্তু চালককে যতই শাস্তি দেওয়া হোক না কেন, যেহেতু তারা কারণ নয়, তাই যারা এটার জন্য মূল দায়ী, তাদের যদি শাস্তি দেওয়া যায় তাহলে এই প্রতিযোগিতার বা পচা সিস্টেমটার পরিবর্তন আসবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের প্রতি হাজার মানুষের বিপরীতে যান্ত্রিক যানের সংখ্যা মাত্র দুটি। অথচ সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গাড়ি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকেরা। প্রতি ১ হাজার মার্কিন নাগরিকের জন্য গাড়ির সংখ্যা ৭৬৫। অথচ ঐ দেশে বছরে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুর হার মাত্র দুই জন।
বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশের শহরাঞ্চলে মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশই ঘটে রাজধানীতে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই এবং অদক্ষ চালকের কারণে যে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে, তাও বহুল আলোচিত। এছাড়া অন্য যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, তাও অজানা নয়। চিহ্নিত সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ কতটা আন্তরিক এটাই বড় প্রশ্ন।
সারা দেশের সড়ক ও মহাসড়কে অদক্ষ চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, খামখেয়ালিপনা, জনসচেতনতার অভাব এবং দায়ী চালকের বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির বিধান না থাকায় অহরহ ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই যন্ত্রদানবের হত্যার শিকার হয়ে দেশের বহু জ্ঞানী, গুণী, বুদ্ধিজীবী, নিষ্পাপ শিশু থেকে বৃদ্ধ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী প্রাণ হারাচ্ছে। চিরদিনের মতো পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে অনেককেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনার জন্য বিআরটিএর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও পুলিশ অনেকাংশে দায়ী।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির রিপোর্ট : জানুয়ারি মাসে ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৫ জন নিহত ও ৮৯৯ জন আহত হয়েছে। একই সময় রেলপথে ৪৪টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত এবং নৌপথে ১৩ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১১ জন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৬৫০টি দুর্ঘটনায় ৬৪২ জন নিহত এবং ৯৭৮ জন আহত হয়েছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। গতকাল শনিবার সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। এছাড়া জানুয়ারি মাসে ২১৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২০৫ জন নিহত ও ১১৪ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছে গণপরিবহন ও যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি।
বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সড়ক, রেল ও নৌপথে দুর্ঘটনার সংবাদ মনিটরিং করে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন। এতে দেখা গেছে, বিগত ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের চেয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে সড়কে দুর্ঘটনা ৫ দশমিক ৩ শতাংশ ও দুর্ঘটনায় আহত ১০ শতাংশ বাড়লেও মৃত্যু ৪ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৯ দশমিক ৫১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৩৮ দশমিক ৬১ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ২৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে গত ১৭ জানুয়ারি। ঐ দিন ৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৩১ জন আহত হয়।
সবচেয়ে কম সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। সেদিন ১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত ও আহত হয় ২১ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় এক দিনে সবচেয়ে বেশি নিহত হয় ১১ জানুয়ারি। সেদিন ২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত ও আহত হয় ১৭ জন।
আরো পড়ুন : ছোঁ মারা পার্টির ১৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগ