প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষায় দেশের ১৬ জেলায় ৫৫০টি ‘মুজিব কিল্লা’ বানানোর সিদ্ধান্ত হয় ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। প্রায় সাড়ে চার বছর পর ১০০টি কিল্লার নির্মাণ বাতিল করেছে পরিকল্পনা কমিশন।
গত জানুয়ারি মাসে কমিশনে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে, সারা দেশে ৪৫০টি কিল্লা হবে। ১০০টি কিল্লা বাতিলের পেছনে দুটি যুক্তি দেখিয়েছে কমিশন। এক, কিল্লার জন্য যেসব স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল, তার সব কটি সঠিক জায়গায় হয়নি। অনেক জায়গায় জমি অধিগ্রহণ করা বেশ জটিল। দুই, ৫৫০টি কিল্লা নির্মাণ প্রকল্পের গতি সন্তোষজনক নয়। এভাবে চলতে থাকলে সব কটি কিল্লা তৈরির কাজ কবে নাগাদ শেষ হবে, তা নিশ্চিত নয়।
‘মুজিব কিল্লা’ বানানোর কাজটি বাস্তবায়ন করছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের ২০২২ সালের ডিসেম্বরের তথ্যমতে, কাজ শুরুর পর গত সাড়ে চার বছরে মাত্র ৬৪টি কিল্লার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ৯৫টির কাজ চলমান।
কিল্লা কীভাবে ব্যবহার হবে, কার তত্ত্বাবধানে থাকবে, এখনো সে নীতিমালা ঠিক হয়নি। ফলে নির্মিত কিল্লাগুলো অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য। গত মঙ্গলবার দুটি জেলায় সরেজমিন দেখা যায়, কিল্লাগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। কোথাও কোথাও কিল্লায় যাওয়ার সরাসরি রাস্তা নেই।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কিল্লা বানানোর জন্য যেখানে যেখানে জমির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে, সেখানে সেখানে তা বানানো হবে। কিল্লার সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর অগ্রাধিকার ঠিক করবে-কোথায় কোথায় তা বানানো হবে, আর কোথায় কোথায় তা বাদ দেওয়া হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মো. ছায়েদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, প্রকল্পের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। সাড়ে চার বছরে অগ্রগতি মাত্র ২৬ শতাংশ। কিল্লা বানানোর জন্য অনেক জায়গায় এখনো জমি ঠিক করা যায়নি। সে কারণে ১০০টি কিল্লা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। কোন প্রক্রিয়ায় কিল্লা হস্তান্তর করা হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। ফলে যেসব কিল্লার কাজ শেষ, সেগুলো পড়ে আছে। তা ছাড়া শুরুতে নকশা নিয়ে জটিলতা ছিল। পরে তা সংশোধন করা হয়। এ কারণেও প্রকল্পের কাজে গতি কমে গেছে।’
অবশ্য ১০০টি কিল্লা কমানোর সিদ্ধান্তে খুশি নয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের যুক্তি, সর্বোচ্চ ৫০টি কিল্লা কমানো যেত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কিল্লা বানানোর জন্য জেলা প্রশাসকেরা যেসব স্থান বাছাই করেছিলেন, সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তা ব্যবহারের অনুপযোগী। আবার কোথাও কোথাও জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খাসজমির চেয়ে ব্যক্তিগত জমি বেশি। কোথাও আবার নিচু জমি দেখা যায়।
২০২১ সালের ৫ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ‘মুজিব কিল্লা’ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিল। যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল বৈঠকে। কিন্তু তারপরও এ কাজ শেষ করতে পারেনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর।
বৈঠকটিতে কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, তাঁর জানামতে, দেশে অনেক ইউনিয়ন বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে, কিন্তু সেখানে কিল্লা নির্মাণ করা হয়নি। অথচ যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে তা নির্মাণ করা হয়েছে। এ কাজের পেছনে কারা জড়িত, তাঁদের খুঁজে বের করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি।
‘মুজিব কিল্লা’বানানোর প্রেক্ষাপট
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, ১৯৭০ সালে উপকূলীয় এলাকায় স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। প্রায় এক লাখ গবাদিপশু মারা যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে মাটির কিল্লা বানানোর নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশে ১৯৭২ সালেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৭২টি মাটির কিল্লা বানানো হয়। পরবর্তী সময় স্থানীয় মানুষ এর নাম দেয় ‘মুজিব কিল্লা’। পরবর্তী সময় সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে কিল্লাগুলো ব্যবহারে অযোগ্য হয়ে পড়ে। এমনকি কিল্লাগুলো বেদখলও হয়ে যায়।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে ‘মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শিরোনামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২১ সালের ডিসেম্বর। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় দেশের ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ১৬ জেলায় ৫৫০টি ‘মুজিব কিল্লা’ বানানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ১৭২টি পুরোনো, ৩৭৮টি নতুন। মূলত সংসদ সদস্যদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এসব কিল্লা বানানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
২০২১ সালের মধ্যেই সব কটি কিল্লা বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তারা কাজ শেষ করতে পারেনি। পরে পরিকল্পনা কমিশন সময় এক বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর করে। খরচ বাড়িয়ে ১ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু ২০২২ সালের ডিসেম্বরে দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ মাত্র ২৬ শতাংশ শেষ হয়েছে।
এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। এ প্রেক্ষাপটে গত ৬ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের ওপর আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেই ১০০টি কিল্লা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেসব কিল্লার কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। আর যেসব কিল্লার কাজ এখনো শুরু হয়নি, সেগুলোর ক্ষেত্রে নতুন রেট শিডিউল (বাজার অনুযায়ী উপকরণের দাম) অনুসারে ব্যয় প্রাক্কলন করা হবে। বাকি থাকা কিল্লাগুলোর কাজ শেষ করতে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়।
১০০টি কিল্লা কমানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক জানে আলম বলেন, ‘আপাতত আমরা ৪৫০টি কিল্লা বানাব। এ প্রকল্পে ১০০টি কিল্লা কমিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।’
কর্মকর্তাদের অদক্ষতার কারণে কিল্লাসংখ্যা কমাতে হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে জানে আলম বলেন, ‘জেলা প্রশাসকেরা আমাদের জমি ঠিক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও গিয়ে দেখা যায়, নদীতে সে জমি ভেঙে গেছে। কোথাও গিয়ে দেখা যায়, জায়গা নিচু বা ব্যবহারের অনুপযোগী। তবে এ বিষয়ে ডিসিদের দায়ী করা যাবে না।’
বাদ দেওয়া ১০০টি কিল্লা পরবর্তী সময় নতুন প্রকল্প নিয়ে বানানো হবে বলে জানান জানে আলম।
সরেজমিন ভোলা
ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চরের বারাইপুর গ্রাম। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এখানে নির্মিত দুটি কিল্লা ফাঁকা পড়ে আছে। লোকজন কিল্লার সামনে পিকনিক করছেন। কিল্লায় যাওয়ার সরাসরি কোনো রাস্তা নেই। কিল্লা দুটি রাস্তা থেকে একটু দূরে অবস্থিত।
সমতল ভূমিতে বালু ফেলে ৭ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হয়েছে। তার চারপাশে পাটাব্লক ফেলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। এই উঁচু জমিতে বানানো হয়েছে কিল্লা।
কিল্লার সামনের মাঠে খোলা বালু। এ বালু বাতাসে উড়ছে। অনেক জায়গায় গর্ত তৈরি হয়েছে। গরুর বাছুর ওঠার জন্য ইট বিছিয়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। কিন্তু রাস্তার কয়েকটি স্থান ধসে গেছে।
কাচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আবদুর রব বলেন, কিল্লা দেখভালের জন্য একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়া জরুরি।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, কিল্লার চারপাশে ব্লক না দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল দেওয়া উচিত ছিল। এ ছাড়া মাঠে ইট বিছিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এতে কিল্লা আরও মজবুত হতো। কিন্তু এখন যে অবস্থা, তাতে বড় ধরনের জলোচ্ছ্বাস এলে বালুর ঢিপি ভেসে যেতে পারে।
ভোলার মনপুরা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. ইলিয়াছ বলেন, যেসব কিল্লা নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো নকশা অনুসারেই হচ্ছে।
সরেজমিন পটুয়াখালী
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ২০টি কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় সব কিল্লা খালি পড়ে আছে।
উপজেলার চাকামইয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা তালুকদার শামসুল আলম বলেন, এসব কিল্লা অব্যবহৃত না রেখে পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া উচিত। এতে তারা এগুলো দেখভাল করতে পারত। এর মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রমসহ বিভিন্ন কাজে কিল্লাগুলো ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হতো। আবার দুর্যোগের সময়ও এখানে মানুষ আশ্রয় নিতে পারত। এমনটা করা হলে কিল্লাগুলো ভালো থাকবে। তা না হলে ক্রমান্বয়ে কিল্লার অবকাঠামোসহ সবকিছু ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়বে।
উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের পূর্ব টিয়াখালী গ্রামের ফোরকান হাওলাদার ও রফিকুল ইসলাম বলেন, তাঁদের বাড়ির পাশে নির্মিত কিল্লার কোনো তদারকি নেই।
পূর্ব টিয়াখালীর একাধিক অধিবাসী বলেন, কিল্লার চারদিকে মাটি ফেলে উঁচু করা হয়েছে। কিন্তু কিল্লার সবদিকে কংক্রিটের ব্লক দেওয়া হয়নি। যার ফলে বর্ষায় কিল্লার উত্তর ও পশ্চিম পাশের পুরো মাটি ধসে নেমে গেছে। ব্লক দিয়ে মাটি রক্ষা করা না হলে একসময় কিল্লার মূল অবকাঠামো ঝুঁকির মুখে পড়বে।
কিল্লার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) কলাপাড়া উপজেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আছাদউজ্জামান খান বলেন, ‘কিল্লাগুলো স্থানীয় লোকজনকে বহুমুখী কাজে ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত। এতে প্রতিটি কিল্লা ভালো থাকবে। আমরা এ নিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে আগেও বলেছি, আবারও বলব।’
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিল্লাগুলোর বিষয়ে না জেনে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণসহ ব্যবহার নিয়ে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় আমরা আলোচনা করব।’
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামতউল্লাহ ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া প্রতিনিধি নেছারউদ্দিন আহমেদ)