শুক্রবার রাত সাড়ে তিনটা। চুয়াডাঙ্গা থেকে পূর্বাশা পরিবহনের একটি বাস যাত্রী নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। বাবুবাজার ব্রিজ পার করে তাঁতীবাজার সিগন্যালের কাছে আসতেই দূর থেকে বাস চালককে ইশারা দেয় এক যুবক। ইশারা পেয়েই চালক গাড়ির সুপারভাইজারকে বললেন-‘চাঁদার টাকাটা বের করেন’। এর মাঝেই চালকের সিটের পাশের জানালার বাইরে এসে হাজির ওই যুবক। হাতে নকশাকাটা লোহার দণ্ড। তার পেছনেই রাস্তার আইল্যান্ডের উপর পুলিশ সদস্যরা দাঁড়িয়ে। কোনো কথা না বলেই তাকে টাকা বের করে দিলেন বাসের সুপারভাইজার। টাকা নিয়ে সিটি করপোরেশনের একটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন ওই যুবক। পরের টার্গেট পেছনের বাস।
বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে যতগুলো যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাক ঢাকাতে প্রবেশ করছে সবক’টি থেকেই চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এর বিপরীত পাশের রাস্তার গাড়িগুলো আবার ঢাকা ত্যাগ করছিল। সেগুলো থেকে ইজারাদার ‘৭-এলেভেন এন্টারপ্রাইজ’ নামে চাঁদা উঠাচ্ছিলেন আরেক দল।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন- ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্লিপ দেখিয়ে সংঘবদ্ধ ওই চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা পুলিশের উপস্থিতিতেই প্রতি রাতে প্রকাশ্যে লাখ লাখ টাকার চাঁদা তুলছেন গুলিস্তান, জয়কালী মন্দির, কাপ্তানবাজার, মতিঝিল, কমলাপুর, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, কদমতলী, পোস্তগোলা, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, কোনাপাড়া, ডেমরা, স্টাফ কোয়ার্টার, মাতুয়াইল মেডিকেল, মেরাদিয়া, নন্দিপাড়া, মাদারটেক, দয়াগঞ্জ, বংশাল, নয়াবাজার, বাবুবাজার, মিটফোর্ড এলাকা থেকে।
পূর্বাশা পরিবহনের চালক বলেন, দিনে হোক আর রাতে, এ এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিটি গাড়িকেই চাঁদার টাকা বাধ্যতামূলক দিতে হয়। টাকা না দিলেই গাড়ির গ্লাস ভেঙে দেয়। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ চলে নির্যাতন। আমাদের কোম্পানিগুলোও জানে এখানের চাঁদা নেয়ার বিষয়। ব্যবসা ও গাড়ির ক্ষতির ভয়ে ঝামেলায় জড়ায় না কেউ। দূরপাল্লার গাড়ির ওই চালক বলেন, আমরা গাড়ি নিয়ে ঢাকার বাইরে থেকে আসি। যাত্রী নামিয়ে আবার গাড়ি ভরে চলে যাই। আর ওরা এখানেই থাকে। সঙ্গে প্রশাসনের সাপোর্টও আছে। দুই-একশ’ টাকা চাঁদা না দিলে হাজার টাকার ক্ষতি হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে চাঁদার টাকা দিয়ে দিই। চক্রটির চাঁদা তোলার কাজে ব্যবহৃত সিটি করপোরেশনের নামে ছাপা ওই স্লিপের একটি কপি মানবজমিনের হাতে এসেছে। নীল রঙের স্লিপের সর্ব উপরে সিটি করপোরেশনের লোগো। পাশেই লেখা- ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা’। এর নিচে চাঁদা আদায়ের বিভিন্ন স্পটের নাম। তার নিচে স্মারক নং-৪৬, ২০৭, ০০২, ১৬, ০৬, ৫৫৫, ২০২৩-২০২৫। আর স্লিপের মাঝে বড় করে লেখা আছে ‘ইজারাদার- ৭-এলেভেন এন্টারপ্রাইজ’।
এদিকে গত রোববার সরজমিন গুলিস্তান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নগর ভবনের পেছনের যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তান ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তা এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান সরণি, ফুলবাড়ী মার্কেটের সামনে, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, নর্থ-সাউথ রোড, গুলিস্তান রোডসহ পুরো গুলিস্তান এলাকা জুড়ে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাসের কারণে সড়কে যানজট। রাস্তাগুলোর একপাশ জুড়ে সারি সারি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির যাত্রীবাস। আর এসব বাসের জন্য মেইন রাস্তার মাঝে ছোট ছোট টেবিল নিয়ে চলছে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম। সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকা বাস, রাস্তার মাঝের কাউন্টার, ভাসমান দোকানে তীব্র যানজট লেগে থাকে পুরো গুলিস্তান এলাকা জুড়ে। আর এই প্রতিটি বাস কোম্পানিকেই মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়।
মো. রাজু নামে স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা সারাদিন এই এলাকায় থাকি। শুধুমাত্র যাত্রীবাহী বাস নয় পণ্যবাহী ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ থেকে শুরু করে প্রায় সব যানবাহন থেকেই চাঁদা আদায় করা হয়। বাদ যায় না সিটি সার্ভিসের বাসও। এই এলাকা দিয়ে গাড়ি যেতেও টাকা দিতে হয়, আসতেও টাকা দিতে হয়। ফুটপাথের দোকান থেকে শুরু করে টং দোকান সকলকেই টাকা দিতে হয়। এসব চাঁদার টাকা ওঠানোর জন্য আলাদা লাইনম্যান নিয়োগ করা আছে।
তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আমরা সকলে মিলে বিভিন্ন সময় সিটি করপোরেশনে অভিযোগ দিয়েছি। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- এ বিষয়ে সিটি করপোরেশন কিছুই জানে না। নগর ভবনের পক্ষ থেকে কোনো চাঁদা ওঠানো হয় না। এরপর আমার বংশাল থানায় জানিয়েছি। থানা থেকে আমাদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তার ভয়ে কেউই লিখিত অভিযোগ দিতে রাজি হয়নি। হাসান নামে এক বাসচালক বলেন, প্রতিদিন যেই চাঁদা নেয়া হয় এটা সব মহলই জানে। সকলেই যার যার ভাগ পেয়ে যায়। তাই কাউকে অভিযোগ করেও তেমন একটা লাভ হয় না। উল্টো অভিযোগ করার দায়ে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তাই ঝামেলার ভয়ে সকলে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এসব চাঁদার টাকা ওঠানোর দায়িত্বে থাকা এক লাইনম্যান বলেন, আমাদের নির্দিষ্ট সময় ও টিম ভাগ করা আছে। আমরা প্রতিদিন টাকা উঠিয়ে ইজারাদারের কাছে জমা দিয়ে দিই। সেখান থেকে আমাদের একটা পার্সেন্টেজ দেয়া হয়। বাকিটা ইজারাদার জানেন। তিনি কোথায় কোথায় এই টাকার ভাগ দেন সে বিষয়ে সঠিক বলতে পারবো না। তবে ইজারাদারের যোগাযোগ ভালো থাকায় তেমন কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না বলেও জানান এই লাইনম্যান।
এ বিষয়ে বংশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মইনুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরাসরি আমাদের কাছে কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন সময় অনেকে আমাদের ফোন করে জানায় তাদের কাছ থেকে সিটি করপোরেশনের টোলের নামে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। তখন আমরা আমাদের টিম পাঠিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখেছি সিটি করপোরেশনের নামে কোনো অবৈধ চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটেনি। যেই টাকা আদায় করা হয়েছে সেটা সিটি করপোরেশনের টোল। এটা সিটি করপোরেশন পেয়ে থাকে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা (যুগ্ম সচিব) আরিফুল হক বলেন, এ বিষয়ে আমাদের কাছেও বেশ কয়েকবার অভিযোগ এসেছে। যানবাহন থেকে এভাবে চাঁদা আদায় মোটেও কাম্য না। আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেবো।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) যুগ্ম সচিব মো. হায়দর আলী বলেন, সিটি করপোরেশন কখনো নিজে কোনো চাঁদা বা টোল আদায় করে না। আমরা শুধুমাত্র আমাদের সিটি করপোরেশনের আওতাধীন টার্মিনাল, জায়গা ইজারা দিয়ে থাকি। সেসব স্থান থেকে ইজারাদাররা শর্ত মেনে টোল বা চাঁদা নিয়ে থাকে। এর বাইরে যেখান থেকেই চাঁদা আদায় করা হোক না কেন তা সবই অবৈধ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।
অঅরো পড়ুন : তারা মনোনয়ন না পেয়ে হতাশ হলেও স্বস্তি আওয়ামী লীগে