মুদি দোকানি থেকে রূপকথার গল্পের মতো বকশীগঞ্জে সাম্রাজ্য গড়েছেন বাবু

অনুসন্ধানী ক্রাইম নিউজ জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি নারী নির্যাতন পুরুষ নির্যাতন প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

ছিলেন মুদি দোকানি। ভাঙাচোরা একটা বাইসাইকেল নিয়ে সেই দোকানের সদাই করতেন। কষ্টেই দিনাতিপাত করতেন। সাদামাটা জীবনযাপনে ছিল না কোনো চাকচিক্য। দিন আনা দিন খাওয়া জীবনে এটাই ছিল চরম বাস্তবতা। জামালপুরের বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর জীবনের এ গল্পটা এখন ইতিহাস। বর্তমানে নামে বেনামে শত কোটি টাকার মালিক তিনি। শুধু কি সম্পদ? দুইদিন আগেও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদকের কথাই যেন আইন ছিল। স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ তার অঙ্গুলি হেলনে উঠতো বসতো। দখলবাজি তার পেশা।

নারীভোগ নেশা। তার সাম্রাজ্যে তার কথাই শেষ কথা। শুধু নিজ ইউনিয়ন নয়, তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি পুরো উপজেলায়। কোনোকিছু একবার নজর কাড়লে সেটা তার যেকোনো মূল্যে চাই-ই চাই। তার মতের বিরুদ্ধে ‘না’ শুনতে রাজি ছিলেন না তিনি। মতের বিরুদ্ধে গেলেই নেমে আসতো নির্যাতনের খড়গ। এজন্য নিজের বাসবভবনের ৩ তলায় তৈরি করেছেন টর্চার সেল। সেই সেলে নিয়মিত মদ, জুয়ার আড্ডা বসতো। বিরোধীপক্ষ এবং চাঁদা ও দখলবাজিতে বাধাদানকারীদের টর্চারসেলে চলতো নির্যাতন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, নিজের বাড়ির পাশে প্রতিষ্ঠিত পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সদস্যদের ব্যবহার করতেন চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কাজে। গতকাল সরজমিন সাধুরপাড়া, ধাতুয়াকান্দা, আইরমারী, কামালের বার্তী, সাধুরপাড়া, খানপাড়া, মোল্লাপাড়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম এবং উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এসব তথ্য মিলেছে। সকালে এসব গ্রামে গিয়ে সুনশান পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, বেশিরভাগ বাড়িতে পুরুষদের অনুপস্থিত দেখা যায়। তবে সাংবাদিক নাদিম হত্যার প্রধান আসামি ইউপি চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তেই গ্রামের পরিবেশ বদলে যায়। মোড়ে মোড়ে জটলা বসে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা এতদিনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বলেন, আজ আমাদের ঈদের দিন। অনুসন্ধান বলছে, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল আলম বাবু’র পাওয়ার হাউজের নেপথ্যে ছিলেন সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক পদমর্যাদার তার এক চাচাতো ভাই। তাকে ব্যবহার করেই মামলা ও তদবির বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। এমনকি পুলিশের সাবেক ওই কর্মকর্তা সামনের নির্বাচনে নৌকার টিকিট পাবেন বলেও এলাকায় প্রচার করেন বাবু চেয়ারম্যান।

গত দু’দিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, ১০ বছর আগে কামালের বার্তী বাজারে মুদি দোকান করতেন বাবু, তার পিতা ও দুই ভাই। সে সময় তিনি অল্প টাকায় ওই বাজারেই ভাড়া থাকতেন।

এরইমধ্যে তার মাথায় আশীর্বাদের হাত পড়ে পুলিশের এআইজি (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত) মোখলেছুর রহমান পান্নার। এক সময় যুবদল করা বাবু খোসল পাল্টে ২০১৪ সালে রাতারাতি নাম লেখান আওয়ামী লীগে। চাচাতো ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে ওই বছরই ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকার টিকিট বাগিয়ে নেন। এরপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তার। একদিকে চেয়ারম্যান, অন্যদিকে প্রভাবশালী চাচাত ভাই এ দুই পরিচয়ে মুদি দোকানি বাবু হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের বদলি বাণিজ্য, মামলার তদবিরের মাধ্যমে অপরাধ জগতের খাতা খোলেন তিনি। মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে, আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে এবং পরবর্তীতে ছাড়িয়ে দিয়েও টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। তার এই ফাঁদ থেকে রেহাই পাননি এলাকায় অনুপস্থিত থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীও। ওই শিক্ষার্থী মাহমুদুল আলম বাবুর ভয়ে এলাকায় আসেন না। থানা পুলিশকে দিয়ে ধরপাকড় বাণিজ্যও আয়ের অন্যতম উৎস। স্থানীয় বিচার সালিশে তার কথাই শেষ কথা। সেখানেও বাণিজ্য। নিয়ন্ত্রণ করেন বিশাল বালু সিন্ডিকেট। তার দাপটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও কোনঠাসা হয়ে পড়েন। একের পর এক জমি ক্রয় করে অঢেল সম্পদের মালিক হতে থাকেন বাবু।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চেয়ারম্যান হওয়ার পর উপজেলার ব্র্যাক রোডে দু’জায়গায় জমি কিনেছেন আলোচিত চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু। এর একটিতে বাড়ি করে বসবাস করছেন তিনি। ঘরের শোভাবর্ধন করেছেন প্রায় কোটি টাকার ফার্নিচার দিয়ে।

এ ছাড়া উপজেলার বাগানবাড়ির নামাপাড়া এলাকায় ৪০ লাখ টাকা দিয়ে ১০ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। চেয়ারম্যান হওয়ার পর ফসলি জমি কিনেছেন ২৬ বিঘা, গাজীপুরের সাইনবোর্ড এলাকায় ১১ শতাংশ জমির ওপর ঘর তুলেছেন। কামালের বার্তী এলাকায় বিপুল পরিমাণ জমি ক্রয় করেছেন। সেখানে তুলেছেন ওই এলাকার একমাত্র তিনতলা বাড়ি। করেছেন অনেকগুলো মার্কেট।

এসবের পর সাংবাদিক নাদিম হত্যার এই প্রধান আসামি নজর দেন দখলবাজিতে। জায়গা-জমি, গাছগাছালি কিছুই তার জবর দখল থেকে রেহাই পায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দ্বিতীয় মেয়াদে চেয়ারম্যান হওয়ার পরই তার নজর পড়ে সাধুরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষী একটি কাঁঠাল গাছের ওপর। মূলত একটি বিলাসবহুল পালঙ্ক তৈরির খায়েশ থেকেই গাছটি কেটে নেন তিনি। বর্তমানে এটিও বকশীগঞ্জে আলোচনায় জায়গা করে নিয়েছে। খাটটি তৈরিতে শুধু মজুরি খরচই পড়েছে আড়াই লাখ টাকা। এ কথা তিনি নিজেই ওই সময় প্রচার করতেন। কামালের বার্তী কেবি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠের একাংশ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন বাবু চেয়ারম্যান। সরজমিন এসবের পাশাপাশি অভিযোগ পাওয়া গেছে আরও জমি দখলের। একই গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মাস্টারের ৩৩ শতাংশ জমি দখল করছেন বাবু। গ্রামের সাজু নামে এক যুবক জানান, বসবাসের জন্য তার শুধু ভিটেমাটিটুকুই আছে। সেটার ওপর নজর পড়েছে বাবু চেয়ারম্যানের। সেটার দখল নিতে হুমকি-ধমকি ও নির্যাতন করে আসছেন। আইরমারী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আজমল হকের জমি দখল করে চেয়ারম্যানের অনুগত একজনের বাড়ি করে দিয়েছেন।

বাবু আটকের পর সাধুরপাড়া ইউনিয়ন: গতকাল সকালে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু গ্রেপ্তারের পর এলাকায় মানুষ দীর্ঘদিনের ভয় কাটিয়ে বের হয়ে আসেন ঘর থেকে। এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরেন তাদের কার্যত জিম্মিদশার কথা। উল্লাস প্রকাশ করে বলেন, আজ আমাদের ঈদের দিন। সাংবাদিক নাদিম হত্যায় জড়িত বাবু চেয়ারম্যানের ভয়ে আমরা বাজারঘাটেও যেতে পারিনি। কেউ কেউ বলেন, তার ভয়ে যুবতী মেয়েরাও ঘর থেকে বের হতে পারেনি। যার ওপর নজর পড়েছে তাকে হেনস্তা না করা পর্যন্ত তিনি থামেননি। হামলা-মামলা দিয়ে নাজেহাল করেছেন। তার চক্ষুশুল হয়ে অনেকেই বিনাদোষে মাসের পর মাস কারাভোগ করেছেন। সম্রাট নামে এলাকার প্রতিবন্ধী এক যুবক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আজ সাধুরপাড়ার স্বাধীনতা দিবস।

বাবুর টর্চাল সেল: মাহমুদুল আলম বাবুর আগে দুইবারের চেয়ারম্যান কামালের বার্তী গ্রামের শয্যাশায়ী হুমায়ুন কবীর কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার ওপর চালানো নির্যাতনের বর্ণনা দেন। বলেন, তার কারণেই আমি আজ স্ট্রোক করে শয্যাশায়ী। বাজারে তার বাড়ির তিন তলায় একটা টর্চার সেল রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন লোকজনকে ধরে নিয়ে যায়। নির্যাতনের পর ১০-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। এ ছাড়া ওই টর্চার সেলে নিয়মিত মাদকের আসর বসে। সাবেক এই চেয়ারম্যানের অভিযোগ, বাবুর বাড়ির পাশে অবস্থিত পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সদস্যরা তার এ অপকর্মে সহযোগিতা করে।

নারী কেলেঙ্কারি: সাংবাদিক নাদিম হত্যার অন্যতম কারণ চেয়ারম্যানের নারী কেলেঙ্কারি তুলে ধরা। সাবিনা নামে এক নারীকে গোপনে বিয়ে, সন্তান জন্ম, অতপর অস্বীকার করার ঘটনা তিনি সংবাদ মাধ্যমে তুলে ধরেন। অসহায় ওই নারী সন্তানের পিতৃ পরিচয় আদায়ে অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘোরেন। পরে সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি তুলে ধরেন। স্থানীয় বেশিরভাগ সংবাদকর্মী বাবুর ভয়ে বিষয়টি চেপে গেলেও নির্যাতিতার পাশে দাঁড়ান সাংবাদিক নাদিম। এরই জের ধরে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া চেয়ারম্যানের নারী কেলেঙ্কারির আরও কাহিনী বেরিয়ে আসছে। ওই ইউনিয়নের এক নারী কাউন্সিলরের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে তিনি ৩ লাখ টাকায় মিটমাট করেন। সেই কাউন্সিলরের সংসার এখন ভঙ্গুর। মামলায় আটক এক আাসামির মেয়েকেও তিনি নির্যাতন করেছেন। এলাকাবাসী জানান, তার ভয়ে বিবাহ উপযুক্ত মেয়েরা রাস্তাঘাটে বের হতেন না।

বাবুর আয়ের বড় খাত: সাধুরপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর আয়ের অন্যতম বড় খাত অবৈধ বালু ব্যবসা। ড্রেজার বসিয়ে দশআনি ও ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে নিয়মিত অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেন। এ ছাড়া তাকে মোটা অঙ্কের মাসোহারা দিয়ে বালু সিন্ডিকেটের ২০-২৫ জন ব্যবসায়ী এই অবৈধ ব্যবসা করে আসছেন। ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে অনেক আবাদি জমি, বাড়িঘর, কবরস্থান বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি তার ভয়ে প্রশাসনও নীরব ভূমিকা পালন করে। মাঝে মাঝে জরিমানা করলেও থেমে নেই অবৈধ এ ব্যবসা। সম্প্রতি বালু সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবদুল গণি মারধরের শিকার হয়েছেন।

বাবু সাম্রাজ্যের সেনাপতিরা: এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবুর এই অপরাধ সাম্রাজ্য পরিচালনায় আছে বিশাল এক লাঠিয়াল বাহিনী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সাংবাদিক হত্যার মিশনে অংশ নেয়া রেজাউল করিম, মনির ড্রেজার মালিক মনির, বাবুর ছেলে রিফাত, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক রাকিব উল্লাহ, ধাতুয়াকান্দার বিল্লাল, বালুগাঁওয়ের ছমাদ, শাহরিয়ার সাঈদসহ অনেকেই।

বাবুর এই অপরাধ জগত সম্পর্কে সাধুরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি আক্কাছ আলী বলেন, বাবুর কারণে এই ইউনিয়নের মানুষ জিম্মি ছিল। সাংবাদিক নাদিম তার এই অপকর্ম সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। তাই তাকে জীবন দিতে হলো। এই ইউনিয়নসহ অত্র অঞ্চলের মানুষ তার ভয়ে চুপ ছিল। আমি নিজেও এলাকায় তার ভয়ে যেতে পারিনি। দীর্ঘদিন পর আজ আমি এলাকায় গেলাম।

আরো পড়ুন : নওগাঁয় বজ্রপাতে চার কৃষকের মৃত্যু

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *