শেষ বিকেলে সূর্যের রূপটা দেখতে কার না ভালো লাগে। কেউ এ জন্য ছুটে যান সমুদ্রপাড়ে, কেউ আবার ভিনদেশে– খানিক বাদে যে চারদিক থেকে নেমে আসবে আঁধার সেটা জেনেও সবাই সূর্যের ওই রূপটার মোহে আকৃষ্ট হন। লিওনেল মেসি যেন ফুটবলের আকাশে শেষ বিকেলের সূর্য।
দুই মাস পরই ৩৬তম জন্মদিনের কেক কাটবেন। কিন্তু তাঁর মাঠের খেলা দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি এতটা পথ পেরিয়ে এসেছেন। মনে হবে আঠারো কি বা একুশের কোনো তরুণ। এই তো গত নভেম্বর-ডিসেম্বরও মেসির রাজত্ব দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। কাতারের মহামঞ্চ মাতিয়ে সোনালি ট্রফি হাতে ফিরেছেন নিজ দেশে। দুঃখ-দুর্দশা আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকা আর্জেন্টিনার মানুষও এই ট্রফিটি দেখে ভুলে যায় তারা ভালো নেই। মেসিদের বরণ করতে রাস্তায় নামে। সেই উৎসব উদযাপন শেষ হয়ে আরও তিন মাস পেরোল। কিন্তু তাদের পাগলামো একটুও কমেনি। আন্তর্জাতিক বিরতিতে মেসিরা আবার দেশে ফেরে। দুটি ম্যাচে এরই মধ্যে অংশও নেয় তারা। সেখানেও আকাশি-সাদার সমর্থকদের উন্মাদনা সবাইকে অবাক করে দেয়। বিশেষ করে তাদের অধিনায়ক, যাঁকে তর্ক সাপেক্ষে এই সময়ের সেরা ফুটবলার ভাবা হয়, সেই মেসিকে ঘিরে চলে দারুণ সব নাটকীয়তা। কখনও ড্রেসিংরুমে, কখনও ডিনারের হোটেলে আবার কখনও ট্রেনিং গ্রাউন্ডে। সর্বত্র যে মেসির জয়গান।
হবেই না কেন? ক্যারিয়ারের শেষবেলায় এসে মেসিও হয়ে গেছেন ফুটবলের নতুন এক সারথি। ৩৬ বছরের আক্ষেপ তাঁর হাত ধরে গুছিয়েছে আর্জেন্টিনা। এর পরও সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। সর্বশেষ ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে বুধবার ভোরে কুরাকাওকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে দেয় আর্জেন্টিনা। যে ম্যাচে একাই তিন গোল করেন মেসি। এর পর সতীর্থ এনজো ফার্নান্দেজকে দিয়ে করান আরেক গোল। তার আগের ম্যাচে পানামার বিপক্ষে মেসির ম্যাজিক্যাল এক ফ্রি কিক খুঁজে নেয় প্রতিপক্ষের জাল। শেষে এসে বোধহয় আরও বেশি নিখুঁত মেসির দেখা মিলছে। অন্তত জাতীয় দলের হয়ে তিনি আছেন বেশ। পরিসংখ্যানও তাই বলবে, নিজের শেষ ১০টি ম্যাচে করেছেন ডজনখানে গোল। পানামা ও কুরাকাও ম্যাচে চার গোল করে গড়েছেন একাধিক রেকর্ড।
পানামার বিপক্ষে পেশাদার ক্যারিয়ারে ৮০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেন। এর পর কিংডম অব নেদারল্যান্ডসের ক্যারিবিয়ান অংশের দেশ কুরাকাওয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কোটায় ১০০ গোলের ল্যান্ডমার্কে পা রাখেন। বর্তমানে আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর গোল সংখ্যা ১০২। যেখানে কেবল পা পড়েছে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ও আলি দাইর। সৌদি আরবের লিগে আল নাসরের হয়ে খেলা সিআর সেভেন জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশি ১২২ গোল করেছেন। আর ইরানের আলি দাই করেন ১০৯ গোল। সে হিসেবে তালিকার তিনের ঘরে আছেন মেসি। আর ব্রাজিল লিজেন্ড পেলে ও নেইমার আছেন একই ঘরে। তাঁরা দু’জনই দেশের হয়ে করেছেন ৭৭ গোল। তার আগে অবশ্য আর্জেন্টিনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোলের আসনটা নিজের করে নেন লিও। যেখানে দুইয়ে থাকা গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার গোল ৫৬টি। আর্জেন্টিনার আরেক কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা করেন দেশের হয়ে ৩৪ গোল।
এত এত রেকর্ডের মালা এখনও যাঁর গলায় উঠছে, তিনি জানি কোথায় গিয়ে থামেন! আর্জেন্টিনার মানুষ যদিও তাঁকে এখনই থামতে দিতে চাইছে না। তাদের চাওয়া মেসি ২০২৪ কোপা আমেরিকা তো অবশ্যই ২০২৬ বিশ্বকাপও খেলবেন। শুধু কি দেশের মানুষ, মেসির সতীর্থরা এমনকি কোচ লিওনেল স্কালোনিও খুব করে চাইছেন মেসি থাকুক, থ্রি স্টার জার্সি জড়িয়ে এমন উদযাপন চালিয়ে যাক। মেসিও এতদিনে হয়তো মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন, সময়টা আরও কিছুদিন উপভোগ করবেন। এভাবে রাঙিয়ে যাবেন ফুটবলের আন্তর্জাতিক অঙ্গন। তা ছাড়া সমর্থকদের এমন রোমাঞ্চ, এমন উচ্ছ্বাস-আনন্দ দেখতে তাঁরও ভীষণ ভালো লাগে। যেমনটা কুরাকাও ম্যাচের পর ইনস্টাগ্রামে জানিয়েছেন, ‘আশা করি, আমরা সবার সঙ্গে এমন আনন্দ আরও ভাগাভাগি করে নেব। আমি চাই, এই গাগলামোর যেন শেষ না হয়।’ তার আগে কনমেবলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তার কন্ঠে ঝরেছিল রোমাঞ্চের সুর, ‘সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, আমি ফুটবলের সবকিছু পেলাম। ধন্যবাদ আমার সতীর্থদের, যাঁরা এমন সুন্দর একটা উপহার আমাদের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কোচিং স্টাফ, তাপিয়া সর্বোচ্চটা দিয়ে আমাদের পাশে ছিলেন। আমাদের যখন যেটা দরকার ছিল, সবই তাঁরা দিয়েছেন। সত্যিই এই ট্রফিটি দিয়ে আমার স্বপ্ন পুরোপুরি পূর্ণ হলো। এটা সেই ট্রফি যেটা আমি খুঁজে বেড়িয়েছিলাম। আসলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমরা যতটা ভালোবাসা পেয়েছি, এখন বুঝতে পারছি বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মানেটা কী।’
আরো পড়ুন : মাদক নির্মূল করতে গিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে ডিএনসি’র কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী