দলের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে নিজ দলের নেতা-কর্মীকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে দলের এ কৌশল এখন অনেক হেভিওয়েট নেতা, মন্ত্রী-এমপির জন্য গলার কাঁটা। শুধু আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র আতঙ্কে রয়েছেন ১৪ দলের শরিকরাও।
শরিক দলের নেতাদের নৌকা দেওয়া হচ্ছে, তার পরও তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে রাখতে কোনোভাবেই রাজি নন। তাঁরা চান না নৌকায় চড়ে আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে লড়াই হোক। আজকালের মধ্যেই পরিষ্কার করতে হবে কারা হবেন নৌকার মাঝি। এজন্য দফায় দফায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটসঙ্গীরা বৈঠক করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, জেপি এবং নতুন নিবন্ধন পাওয়া সুপ্রিম পার্টিসহ মোট সাতটি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তারা নৌকায় চড়ার সংকেতের অপেক্ষায়। অন্যদিকে শান্তি নেই নির্বাচনে আসা জাতীয় পার্টি, তরিকত ফেডারেশনসহ বিএনএম, তৃণমূল বিএনপিতেও। এ ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বেশ কয়েকটি দল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা করেছে। সরকারের প্রতি আস্থা রেখে তারা ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি যেন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন সেজন্য আওয়ামী লীগের আসন ‘ছাড়’ চেয়েছেন কেউ কেউ। এসব নেতা চান, হয় নৌকায় চড়ে অথবা ‘ছাড়’ দিয়ে বা ‘ছেড়ে’ দিয়ে আওয়ামী লীগ তাঁদের সংসদে নিয়ে আসুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি তাঁদের।
বর্তমান সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বরাবরই বলে আসছে তারা আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট পেলেই ক্ষমতায় চলে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটি মাঠে থাকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের। তবে আসন সমঝোতা নিয়ে বারবার আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছে জাতীয় পার্র্টি। গতকাল রাতেও বৈঠক করেছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি।
গতকাল দুপুরে বনানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আমাদের শতভাগ আস্থা রয়েছে। বৈঠকে ক্ষমতাসীনদের ব্যবহারে মনে হয়েছে আমাদের ওপরও তাদের যথেষ্ট আস্থা রয়েছে।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনের আগে দফায় দফায় বৈঠক চলবে বলেও জানান তিনি। চুন্নু বলেন, ‘আমরা জনগণের কাছে আসন চাই। কোনো দলের কাছে চাই না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটের পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আপনারা যেটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন সেটা নিয়ে যে আলোচনা হয়নি তা নয়, অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’ আওয়ামী লীগের এক সূত্র জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কাছে একটি তালিকা দিয়েছে জাতীয় পার্টি। সে তালিকা অনুযায়ী সিট ছাড় চায়। জাতীয় পার্টির অন্যতম শর্ত হচ্ছে, ওইসব আসনে নৌকার কোনো প্রার্থী থাকতে পারবে না। তারা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীকে নিয়েও ভয় পান। আবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে যারা নৌকা পেয়েছেন তাঁরাও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভয় পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থী বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বিভিন্ন জায়গায়। নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্রমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৮ আসনে প্রথমে প্রার্থী ঘোষণা করে। এরপর ঝালকাঠি-১ আসনে প্রার্থী বদল করে। সেখানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাজাহান ওমরকে নৌকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে তিনটি আসনে নৌকার প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাঠে রয়েছেন ২৯৫ জন। জোটের কারণে কয়েকজন এমপি প্রার্থীর কপাল পুড়তে পারে। আজকালের মধ্যেই এ সিদ্ধান্ত দেবেন আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড।
জানা গেছে, ৩০০ আসনের মধ্যে শীর্ষনেতা ও মন্ত্রী পর্যায়ে মাত্র ৩২ নেতার আসন বাদ দিয়ে বাকি সব আসনে রয়েছেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী। তাদের বেশির ভাগই দলের পদধারী, অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশ শক্তিশালী। এটিই এখন আওয়ামী লীগের কিছু প্রার্থীকে চরম ঝুঁকিতে ফেলেছে। দল হিসেবে দ্বিধাবিভক্ত করার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি আসন হাতছাড়া হওয়ারও জোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে ঝুঁকিতে থাকা নেতা-মন্ত্রী-এমপি ও নৌকা পাওয়া প্রার্থীরা মুখে কিছু না বললেও ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের নিয়ে ঘুম হারাম করছেন। তাঁরা নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে আসলে আওয়ামী লীগের কৌশল শেষ পর্যন্ত কী হচ্ছে! কিন্তু সরাসরি ক্ষোভ প্রকাশ করছেন জোট শরিকরা। তারা বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠকে নৌকার প্রার্থীকে তো বটেই, দলীয় স্বতন্ত্রকে বসিয়ে দেওয়ারও কথা বলছেন।
এ প্রসঙ্গে ১৪-দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘আসন বণ্টন নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে। অপেক্ষায় আছি আজকালের মধ্যেই সমাধান করবে আওয়ামী লীগ।’
জোটের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকা প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু আরও বলেন, ‘জোটের আসনে আওয়ামী লীগের বড় নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অর্থ হচ্ছে, এক হাতে দিয়ে আরেক হাতে সিটটা কেড়ে নেওয়া। আমি আশা করি জোটনেত্রী শেখ হাসিনা ও জোটের সমন্বয়ক তাঁরা বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, আওয়ামী লীগ নৌকা দিল, আবার সেখানে তাদের দলের প্রার্থীও থাকল- এর মানে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগ বনাম জাসদ, আওয়ামী লীগ বনাম ওয়ার্কার্স পার্টি বা আওয়ামী লীগ বনাম তরিকত ফেডারেশন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট শরিকদের যতগুলো বৈঠক হয়েছে, প্রতিটি বৈঠকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে কথা তুলেছেন। নৌকার প্রার্থীকে বসিয়ে যেমন তাদের নৌকা দিতে হবে, একইভাবে আওয়ামী লীগের নেতা যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মাঠে না রাখার পক্ষে জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা কাউকে দেয়নি। জাতীয় পার্টিও আওয়ামী লীগের কাছে আসন ছাড় চায়। সে বিষয়ে দুই দলের নেতারা বৈঠক করলেও ‘নির্বাচন’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উভয় পক্ষই দাবি করে আসছে।
এদিকে যেসব আসনে শক্তিশালী দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, সেসব জায়গায় চরম টেনশনে রয়েছেন নৌকার প্রার্থীরাও। তাঁরা দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ নির্বাচনি এলাকায় না থেকে ঢাকায় দলীয় সভানেত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে এসে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে দলের সিদ্ধান্তে কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে প্রার্থীদের জানিয়ে দিচ্ছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক। একইভাবে এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলছেন তিনি। গত দুই দিনে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী যদি হেভিওয়েট কারও সীমানা পেরিয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে যায় (জয়ী হয়), এটাতে আমরা বাধা দিতে পারি না। গণতন্ত্র হলো প্রতিযোগিতা। সুষ্ঠু নির্বাচন, সুস্থ প্রতিযোগিতা। এখানে প্রার্থীকে প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করি আমরা।’ একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ থেকে যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের বহিষ্কারের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেই বলেও জানিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।
কেন্দ্রের এমন নির্দেশনা ও মনোভাবের কারণে এ নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা কিছু বলতে পারছেন না। কিন্তু বেশ অস্বস্তিতে আছেন তাঁরা। বিশেষ করে যেসব জায়গায় নৌকার প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র শক্তিশালী, সেখানে অসহায় আত্মসমর্পণ ছাড়া কিছুই করার নেই আপাতত।
আরো পড়ুন : হলফনামার তথ্যমতে অর্থ ও সম্পদের যেন শেষ নেই বর্তমান ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের