মেয়াদের আগে ভোট হলেও প্রস্তুতি রাখার নির্দেশ
অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের বাধা চিহ্নিত করার নির্দেশনা
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতার ওপর গুরুত্বারোপ
সাহসী ও দক্ষ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের নির্দেশনা
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ করতে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে রাখব। সংবিধান অনুযায়ী সময়ে যেন নির্বাচন করতে পারি। সংবিধানে নির্দিষ্ট সময়ের আগেও নির্বাচন হতে পারে এমন প্রভিশন আছে। নির্দিষ্ট সময়ের দু-এক মাস আগে ভোট হলেও নির্বাচন করার প্রস্তুতি যেন ইসির থাকে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি সামগ্রী ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা হয়ে থাকে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এসব নির্দেশনা দেন। সভায় পক্ষপাতহীন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের ওপর জোর দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, সভায় সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে কী কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ আছে তা মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান সিইসি। একইসঙ্গে তাদের কাছে ভোট সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে করণীয় কী সে বিষয়ে পরামর্শও নেন। সভায় ইসি সচিবালয় ও মাঠপর্যায়ের কয়েক কর্মকর্তা তাদের বক্তব্যে আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান।
আচরণবিধি লঙ্ঘন বা নির্বাচনি অভিযোগ জানাতে ৯৯৯-এর মতো হটলাইন চালুর পরামর্শ দেন। সভায় ভারতের ভোটগ্রহণের উদাহরণ নিয়েও আলোচনা হয়। নির্বাচনে প্রশাসনের বাইরে অন্য বিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়েও আলোচনা হয়। ইসি সূত্র জানায়, এটি নির্বাচন কমিশনের মার্চের সমন্বয় সভা ছিল। মাসিক এ সভায় সভাপতিত্ব করেন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রথা ভেঙে এই প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনার নিজেদের আগ্রহ থেকেই অংশ নেন। এতে মূলত সিইসি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা দেন। সভায় ইসির মাঠপর্যায়ের ১০ অঞ্চলের আঞ্চলিক কর্মকর্তা, ইসি সচিবালয়, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ ও নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেননি। তবে সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে ব্রিফিং দেন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে সচিবলায়কে নির্দেশনা দিয়েছে। ঘোষিত রোডম্যাপ থেকে প্রস্তুতি যেন পিছিয়ে না থাকে সে বিষয়ে সতর্ক করেন।
নির্বাচনের টপ টু বটম, যেমন মালামাল ক্রয় থেকে শুরু করে ভোটকেন্দ্র স্থাপন পর্যন্ত সব বিষয়ের ওপর তারা রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের বলেছেন কোন কোন বিষয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, মাঠপর্যায় থেকে আমরা জানতে চেয়েছি ব্যালট বক্সগুলো কোথায় আছে, কিভাবে আছে, সেগুলোকে কিভাবে যাচাই করে তারা আমাদের রিপোর্ট দেবে-এসব বিষয় নিয়ে আলোচন হয়েছে। এগুলো বাস্তবিক অর্থেই ইসির অভ্যন্তরীণ কাজ।
সূত্র জানায়, বৈঠকে কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, সংবিধান অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা জানুয়ারির শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। আবার সংবিধানে ওই সময়ের আগেও ভোট হতে তার প্রভিশন রয়েছে। সংবিধান সামনে রেখেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনি সামগ্রীর যেগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, অনেক সময়ে নানা জটিলতায় শিপমেন্ট ফেল করে, মালামাল ক্রয়ের ই-টেন্ডার বাতিল হয়। কিন্তু ওই অজুহাতে নির্বাচন আয়োজনে ফেল করার সুযোগ নেই। প্রয়োজনে আগেই প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো শেষ করতে হবে।
সভায় আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ করার ওপর জোর দেন সিইসি। আলোচনার একপর্যায়ে বিগত নির্বাচনগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ভূমিকার বিষয়টি উঠে আসে। সভার একপর্যায়ে সিইসি কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, ব্যালট বক্সে ইসি সরবরাহ করেনি এমন ব্যালট পেপার ঢুকিয়ে রাখার সুযোগ আছে কিনা?
জবাবে ইসি কর্মকর্তারা বলেন, ব্যালটের মুড়ির সঙ্গে হিসাব মেলালে বাড়তি ব্যালট পেপার ঢুকানো হলে তা ধরা পড়ে। এ ধরনের কাজ যাতে না হয় সেই প্রস্তুতি রাখতে নির্দেশনা দিয়েছেন সিইসি।
সভায় আলোচনা উঠে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে একদিনে ভোট হওয়ায় পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট পাওয়া যায় না। তখন সিইসি বলেন, প্রশাসনের বাইরে নির্বাচন কমিশনসহ অন্য যেসব বিভাগ রয়েছে তাদের কর্মকর্তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা সীমিত আকারে দেওয়া যায় কিনা-তা দেখা দরকার।
নির্বাচনে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বন করার নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তার নিজ দক্ষতা ও সাহসিকতায় ভোট তুলতে পারবেন-এমন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। সভায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন সিইসি।
সভায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা আধুনিকায়নের নির্দেশনা দেয় কমিশন। এতে বলা হয়, ভোটকেন্দ্রে নির্ধারণে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, ওসি জানেন কোথায় ভোটকেন্দ্র হলে ভোটারদের নিরাপত্তা দেওয়া সহজ হবে। আর শিক্ষা কর্মকর্তা জানেন, কোন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো ভালো রয়েছে।
সমন্বয় সভায় মাঠ কার্যালয় নিয়েও আলোচনা হয়, দেশের ৩টি জেলা ও ৪৫টি উপজেলায় পৃথক নির্বাচন অফিসের ভবন নেই। সেখানে সরকারি ভবনে নির্বাচন অফিস রয়েছে। এসব ভবন নির্মাণে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনার জন্য সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া ইসির শূন্য পদের বিষয়ে পরিসংখ্যান দিয়ে বলা হয়, নির্বাচন কমিশনের মঞ্জুরি করা বিভিন্ন ধরনের পদের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৬১টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ২ হাজার ২৫৭ জন। বাকি ২ হাজার ৬০৪টি পদ খালি আছে। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির শূন্য পদের সংখ্যা ১৬৬টি।
সমন্বয় সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব, বেগম রাশেদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
গেজেট প্রকাশের আগে ভোট বাতিলের প্রস্তাব আরপিও সংশোধনে : গেজেট প্রকাশের পর ফল বাতিলের ক্ষমতা রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে-এমন বক্তব্য সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
সমন্বয় সভা শেষে ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে তিনি বলেন, আরপিও নিয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়েছে। সেখানে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। নীতিগত অনুমোদন বলতে যে প্রস্তাবগুলো আছে সেগুলো আইন মন্ত্রণালয় আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখবে। তারপর পরবর্তী সভায় উত্থাপন করবে। কোনো অংশ বাতিল বা কোনোটা রাখা হবে সেটা কিন্তু নীতিগত অনুমোদনের সময় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় না। মিডিয়াতে দুটো বিষয়ে ভিন্নরকম প্রতিবেদন এসেছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের আগে ফল বাতিলের ক্ষমতা রেখে সংশোধনী প্রস্তাব করেছে। এখানে বলা হয়েছে, ফলাফল তৈরির সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা বিবরণীটা কমিশনে পাঠাবে। তখন যদি গুরুতর কোনো অনিয়ম হয় নির্বাচন কমিশন যথাযথ তদন্ত করবে। তদন্তে যদি মনে হয় ফলাফল ঠিক আছে, তাহলে তারা প্রকাশ করবে। অন্যথায় ওই গুরুতর অপরাধে ফলাফল সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি, তখন তারা বাতিল করতে পারবেন।
তিনি বলেন, মিডিয়াতে প্রতি আসনে একজন রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের কথা বলা হয়েছে, তা নয়। আইনের ধারাটা না পড়েই ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল কমিশন সভায় নির্ধারণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
আরো পড়ুন : সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় র্যাব সদর দপ্তরের তদন্ত শুরু, ১১ সদস্যকে তলব