মেরা দিলভি কিতনা পাগল হে/ এ পেয়ার তো তুমছে কারতা হে’-ভারতীয় জনপ্রিয় শিল্পী কুমার শানু আর অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া ‘সাজন’ সিনেমার এই গানই অস্পষ্ট স্বরে গাইছিলেন এক প্রবীণ। কাছে গিয়ে বসতেই গান থামিয়ে পরিচয় আর কেন আসা-সেসব জানতে চাইলেন।
পরিচয় দিতেই অভিভাবকের মতো একটির পর আরেকটি প্রশ্ন, ‘বিয়ে করেছ? বাড়ি কোথায়? গ্রামে কে কে থাকে? ভাইবোন কতজন?’ উত্তর পেয়ে তুষ্ট হলেন শেখ মুজিবুল হক। যাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় শ্রেণিকক্ষের ভেতরেই কেটেছে। শিক্ষার্থীদের হই–হুল্লোড়ের মধ্যেই কেটে যেত তাঁর প্রতিটা দিন। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে কখন যে বিকেল হয়ে যেত, সেসব টেরও পেতেন না।
তবে প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় মুজিবুলের জীবনের ঘড়ির কাঁটা চলছে মন্থর গতিতে। বেশির ভাগ সময় মুজিবুল এখন নীরব দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো স্মৃতিচারণা করতে করতে গান ধরেন অস্পষ্ট স্বরে।
শেখ মুজিবুল হক রাজধানীর আগারগাঁওয়ের প্রবীণ হিতৈষী সংঘের প্রবীণ নিবাসের সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা। ৮২ বছরে পা দিয়েছেন বলে জানালেন। আজ মঙ্গলবার ঈদের দিন দুপুরে টানা আধা ঘণ্টার বেশি সময় কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
মুজিবুল হক বললেন, গানের শখ ছিল। মুঠোফোনে গান শুনতেন। কিন্তু সেটি বছর চারেক আগে চুরি হয়ে গেছে। তাই আর গান শোনা হয় না। তবে যে গানগুলো জানা ছিল, এখন সেগুলোই স্মৃতি থেকে মনের প্রশান্তির জন্য গান।
কেমন কাটছে ঈদের দিন, এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘ভালোই আছি। কিন্তু আমার সঙ্গে যাঁরা এখানে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই মারা গেছেন। ঈদের দিন তাঁদের খুব মনে পড়ে। তাঁদের খুব মিস করছি।’ এরপরই আবার বিয়ে না করার প্রসঙ্গটি টেনে এনে প্রতিবেদককে ভালোবাসা মাখা পরামর্শ দিয়ে বললেন, ‘বিয়ের পর মা-বাবাকে যেন আবার ভুলে যেয়ো না। সব সময় ভালো থেকো।’
জীবনের শেষ সময়টুকু প্রত্যেক মানুষ চান ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাতে। কিন্তু সবার কপালে তা হয় না। শেষ বয়সে এসে অনেকের জীবন কাটে বৃদ্ধাশ্রমে।
মনে চাপা কষ্ট থাকলেও এমন জীবনাচারে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন বলে জানালেন প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দারা। জানালেন, ভালোই আছেন। ঈদের দিনও ভালো কাটছে। ঈদ উপলক্ষে দুপুরে দেওয়া বিরিয়ানি সবাই মিলে একসঙ্গে আনন্দ নিয়ে খেয়েছেন। কারও কারও সন্তান কিংবা স্বজনেরা ঈদে নতুন পোশাক পাঠিয়েছেন। উপহারও পেয়েছেন পরিচিতদের কাছ থেকে। কেউ আবার নিজেই নিজের জন্য কিছু কেনাকাটা করেছেন।
মুঠোফোনে ভিডিও কলে স্বজন ও পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলছিলেন ওই নিবাসের আরেক বাসিন্দা নাদিরা বেগম। ৭০ বছর বয়সী এই নারী ছয় বছর ধরে ওই নিবাসে আছেন।
ভিডিও কলে নাদিরা বেগম যে নারীর সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি একসময় তাঁর প্রতিবেশী ছিলেন। রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী এলাকায় থাকতেন তাঁরা। ওই সাবেক প্রতিবেশীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন, নাতি-নাতনির (অপর প্রান্তে থাকা নারীর ছেলেমেয়ে) কেমন আছে, কী করছে জানতে চাইলেন।
নাদিরা বেগম বলেন, জীবনে ভালো ও মন্দ সময় দুটোই আছে। কিন্তু একজন মানুষের সব সময় উচিত খারাপ সময়কে বদলে ফেলার, মুছে ফেলার চেষ্টা করা। তখন যেকোনো সময়ই ভালো থাকা যায়।
সকালে একটু খারাপ লাগছিল জানিয়ে নাদিরা বেগম বলেন, ‘ভাবছিলাম, না জানি দিনটা আজকে কেমন যাবে। তাই জামা পাল্টে নতুন একটি জামা পরে নিলাম। নাশতার পর দেখলাম, অনেকেই (গণমাধ্যমকর্মীরা) আসছে। তাদের সঙ্গে কথা বললাম। ভিডিও কলেও অনেকের সঙ্গে কথা হলো। এভাবে কথা বলতে বলতে কখন যে সময় কেটে গেল, টেরও পেলাম না। দুপুরে খেতেও দেরি হয়ে গেল।’
কথাটি বলেই মৃদু হাসলেন তিনি। বললেন, ‘ভালো থাকতেও অভিনয় জানতে হয়। ভালো থাকার চেষ্টাটাই হলো অভিনয়। এই অভিনয় এখন শিখে গেছি।’
নাদিরা বেগমের নজরুলসংগীত পছন্দ। মন খারাপ লাগলে চলে যান ধানমন্ডির নজরুল ইনস্টিটিউটে। সেখানে অনেকেই তাঁর পরিচিত। গিয়ে দেখা করেন, গল্প-আড্ডা দেন, গান শোনেন, ভালো লাগা নিয়ে আবার ফিরে আসেন।
নিজের ছোটবেলার ঈদ স্মৃতি নিয়ে বললেন, ‘যখন ছোট ছিলাম, তখন ঈদের নামাজের পরেই দল বেঁধে পাড়ায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়তাম। বাড়ি বাড়ি যেতাম, সেমাই, পায়েস, পিঠা খেতাম। নিজের ঘরে ফিরে আর খাওয়া হতো না। এখন তো অনেক বদলে গেছে। এখন ঘরে খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে আর ওই আনন্দ থাকে না। আজকে অনেক দিন পর সবার সঙ্গে (প্রবীণ নিবাসের বাসিন্দা) একত্রে দুপুরের খাবার খেয়ে ভালো লেগেছে।’
পাঞ্জাবির পকেট থেকে চকচকে ২০ টাকা ও ৫০ টাকার নোট বের করে প্রবীণ নিবাসের কর্মীদের ঈদের সালামি দিচ্ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওয়াকিল হাক্কানি। সালামি বিতরণের সময় কর্মীদের মাঝে আনন্দ দেখা দিল। অনেকে সালামি নিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করছিলেন। আর তাতে মুখে হাসির ঝিলিক নিয়ে আবদুল ওয়াকিলকে বলতে শোনা যায়, ‘আরে থাক থাক, লাগবে নারে পাগলি। আমার জন্য দোয়া করিস, যেন ভালো থাকতে পারি।’
আবদুল ওয়াকিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বললেন, ‘পরিবারকে খুব একটা মিস করি না। এখানে ভালোই আছি। এদের সবাইকে (নিবাসের অন্য বাসিন্দা ও কর্মী) নিয়েই এখন আমার পরিবার। এদের সঙ্গেই সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিই। বছরের প্রতিটি দিনই তো তাদের কাছে পাই।’ কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা ভারী হয়ে গেল আবদুল ওয়াকিলের গলার স্বর। বোঝা গেল পরিবারকেও হয়তো মনে পড়ছে তাঁর।
প্রবীণ নিবাসের অনেক বাসিন্দার মধ্যে অন্য রকম সোহেলি আক্তার। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। তাঁর প্রবীণ নিবাসে যাওয়া নিঃসঙ্গতা কাটাতে। কারণ, সোহেলির দুই মেয়ে স্বামী-সন্তান নিয়ে প্রবাসে। মেয়েরা অনেকবার তাঁকেও সেখানে চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু তাঁর মন কখনো বিদেশে যেতে সায় দেয়নি। অনেকবার বেড়াতে গিয়েছেন। কিন্তু একবারও স্থায়ীভাবে সেখানে থেকে যাওয়ার কথা মনেই হয়নি।
সোহেলি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড এলাকায় নিজের বাড়ি আছে। কিন্তু বাসায় একা একা থাকতে হয়। নিঃসঙ্গতা কাটাতেই প্রবীণ নিবাসে একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন। খারাপ লাগলেই চলে আসেন। এখানে এলে নিঃসঙ্গতা কিছুটা কাটে। কারণ, এই নিবাসের অনেক বাসিন্দার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই আবার নিজের বাড়ি গিয়ে থাকেন।
বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘের ওই প্রবীণ নিবাসে ২৯ জন বাসিন্দা আছেন। এর মধ্যে ১৫ জন নারী ও ১৪ জন পুরুষ। ওই নিবাসে আসন আছে ৫০টি।
ওই নিবাসের ব্যবস্থাপক মহসীন কবির বলেন, ঈদের দিন খুব কমই পরিবারের লোকজন আসে। মূলত ঈদের পরদিন কিংবা তার পরের দিনগুলোতে অনেকেই এসে দেখা করে যান। প্রবীণ বাসিন্দাদের শিশুসুলভ আচরণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দিনই তাঁরা একে অন্যের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ করেন। কোনো কোনো বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা-কাটাকাটিও করেন। পরক্ষণেই আবার বন্ধুর মতো মেশেন, কথা বলেন, গল্প-আড্ডা দেন। তবে তাঁদের প্রবীণ নিবাসের প্রত্যেক বাসিন্দাই স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারেন।
আরো পড়ুন : যাত্রার শেষ ১৫ থেকে ১৭ মিনিট ছিল জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়