বিদ্যুৎ না নিয়েই সরকার বছরের পর বছর দেশের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে। আর বিদ্যুৎ খাতের এই বাড়তি ব্যয়ের জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুতের দামও বাড়ছে। আর শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির মাশুল দিতে হচ্ছে গ্রাহককে। ফলে ক্যাপাসিটি চার্জের জন্য সরকারকে শুধু ভর্তুকির বোঝাই টানতে হচ্ছে না, বিপাকে পড়ছেন সর্বস্তরের গ্রাহকও। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা যায়, কোনো বিদ্যুৎ না নিয়েই গত ১১ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকার বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জের এই বোঝা বহন করতে হবে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল-আইএমএফ কর্তৃপক্ষ সরকারকে সতর্ক করেছে। আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে ক্যাপাসিটি চার্জ থেকে সরকারকে ভারমুক্ত হতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের চুক্তি নিয়েও পর্যালোচনা করতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে এখন কৃচ্ছ্রতা সাধন করতে হবে। আর এমনটি করতে হলে কিছু কোম্পানিকে লাভবান করার প্রক্রিয়া থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কিছুদিন আগে জানানো হয়, সরকারি-বেসরকারি ৯০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। এই হিসাবে প্রতি মাসে গড়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ভাড়া দিতে হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যে জানা যায়, দেশে বর্তমানে সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্মিলিতভাবে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের করা ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কেনা না হলেও কেন্দ্রগুলোকে ভাড়া বাবদ নির্দিষ্ট হারে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। আর এই ৯০ হাজার কোটি টাকা কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে।
সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরুর দুই বছর পরও জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়নি পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কেন্দ্রটি সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাইন টানতে একটু বেশি সময় লাগছে। তারা আশা করছেন চলতি বছরের ডিসেম্বরেই কাজ শেষ হবে। তবে ডিসেম্বরেও কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা আছে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না পারলেও গত দুই বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ সরকারকে গুনতে হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হলে বিদ্যুৎ না নিয়েও আরও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হতে পারে।
এর বাইরেও উৎপাদন না করে বসিয়ে রেখে টাকা ব্যয়ের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে সামিট, ইউনিক ও রিলায়েন্সের ১ হাজার ৯০০ মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসভিত্তিক (এলএনজি) আরও তিনটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বেসরকারি এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিনটি নির্মাণ করা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। সামিট পাওয়ার, ইউনিক গ্রুপ ও ভারতের রিলায়েন্স গ্রুপ পৃথকভাবে এগুলো নির্মাণ করছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদনে যাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো প্রস্তুত হয়ে গেলে গ্যাসের অভাবে চালু করতে না পারলেও এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে সরকারের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।
বিদ্যুৎ বিভাগের দেওয়া তথ্যে, দেশে বর্তমানে মোট ১৮টি রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ নীতিতে চলছে। আর বাকি ৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র আগের নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছে। এদের ক্যাপাসিটি চার্জসহ যাবতীয় খরচ দিতে হচ্ছে সরকারকে। এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের ১০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ক্যাপাসিটি চার্জ না দিলেও কেন্দ্রগুলো চালাতে জ্বালানি ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে জনবল প্রয়োজন তার খরচ সরকারকে দিতে হবে। বাকি যে আটটি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে সেগুলোর মেয়াদ শেষ হলে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা ভবিষ্যতে এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে চাই। এর বাইরে ভারত থেকে বর্তমানে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। এ জন্য গত তিন অর্থবছরে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে। ভারতের আদানি গ্রুপের গড্ডা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৫ বছর বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। আগামী ডিসেম্বর থেকে আদানির বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর কথা। তবে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাংলাদেশের অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। জানা যায়, চুক্তি অনুসারে ২৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আদানি গ্রুপকে প্রায় ১ লাখ কোটি টাকা দিতে হবে।
বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল-আইএমএফ। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ কবে নাগাদ বন্ধ হবে সে বিষয়ে জানতে চেয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরের সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও পিডিবির সঙ্গে আলাদা বৈঠকে এসব বলেন। বর্তমানে বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। ২০৩০ সালেও এটি শেষ হবে না। এ খাতে কত ব্যয় হবে এগুলোর কারণে সরকারের ঋণ কেমন বাড়ছে সে সম্পর্কে আইএমএফ জানতে চায়। তারা মনে করেন, সরকারের ঋণের টাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে। আর ক্যাপাসিটি চার্জ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধের কারণে অর্থনৈতিক সংকট আরও বাড়ছে। এ জন্য আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রায় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে দেশে এমন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে কি না যেগুলো সারা বছরের মধ্যে মাত্র দুই সপ্তাহ ব্যবহৃত (্উৎপাদন) হয়েছে। এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে সারা বছর বসিয়ে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিলে সেটিই হবে চরম দুর্নীতি। এ ধরনের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে যে, সেই কোম্পানির সঙ্গে কোনোরকম বোঝাপড়া আছে। পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য বসে ছিল কিন্তু সঞ্চালন লাইন তৈরি না হওয়ায় আমাদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হয়েছে। এখানে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার দুর্বলতার কারণে এমন হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারেরও দায় আছে। আশঙ্কা করছি নির্মাণাধীন এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ শুরু না করতে পারলে এগুলো বসে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তারা উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার ঘোষণা দিলে গ্যাস না পেলে বড় আকারে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হতে পারে। আবার আদানি যদি ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেওয়ার কথা বলে এর বিপরীতে বাংলাদেশ সঞ্চালন লাইন নির্মাণে সীমাবদ্ধতাসহ অন্য কারণে ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ নিতে না পারে তাহলে তাদেরও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হতে পারে। অর্থাৎ জ্বালানি খাতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে এই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে।’
সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন
আরো পড়ুন : দিনে বিরান ভূমি হলেও বিশ্বকাপের শহর জেগে ওঠে রাতে