অডিট আপত্তির ৮,৫৫১টি অভিযোগে সরকারের রাজস্ব আটকে আছে ২০,৭২১ কোটি টাকা

অনুসন্ধানী অর্থনীতি

অডিট আপত্তির ৮ হাজার ৫৫১টি অভিযোগে আটকে আছে সরকারের ২০ হাজার ৭২১ কোটি টাকার রাজস্ব। আয়কর, ভ্যাট এবং শুল্ক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে এসব আপত্তি তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট নিয়ে অভিযোগ রয়েছে ৪ হাজার ৭৩২টি। এতে আটকা পড়েছে ১৭ হাজার ৮০৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এনবিআরের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। আটকে থাকা করের টাকা আদায় হলে সরকারের বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমে আসবে বলে রাজস্ব সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং শুল্ক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে বিভিন্ন সময় এসব আপত্তি তুলেছে। এসব আপত্তির মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বিভাগের অভিযোগ রয়েছে ৪ হাজার ৭৩২টি। এতে আটকা পড়েছে সরকারের ১৭ হাজার ৮০৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। যা মোট আটকে থাকা অর্থের ৮৬ শতাংশের বেশি। তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক শাখা ৪৩২ কোটি ১৪ লাখ টাকার ১ হাজার ৪৮১টি অভিযোগ তুলেছে এবং আয়কর শাখা ৬২ কোটি ১ লাখ টাকার ২ হাজার ২৮২টি অভিযোগ করেছে। রাজস্ব বোর্ড প্রশাসন অনুবিভাগের দায়েরকৃত ৯টি অভিযোগে কর ফাঁকির পরিমাণ ২ হাজার ৪১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের ৩১টি অভিযোগে আটকা পড়া করের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্র জানায়, ভ্যাট আটকে যাওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি দেশের বড় কোম্পানি।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ বলেন, অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির মাধ্যমে দ্রুত অর্থ উদ্ধারের দিকে নজর দেওয়া উচিত রাজস্ব বোর্ডের। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এই অর্থ উদ্ধারের অগ্রগতি জানতে চাইতে পারে এনবিআরের কাছে। কারণ, অডিট আপত্তির অর্থ উদ্ধার একটি দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়া। অডিট আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। টাকা আদায়ে নিয়মিত ফলোআপ জোরদার করতে হবে। কারণ, সরকারের টাকা এখানে আটকে আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যয় বাড়াতে আটকে পড়া অর্থ উদ্ধার করা হবে রাজস্ব আয়ের একটি ভালো উৎস। এনবিআরকে এ ধরনের অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য আরও সহযোগিতামূলক হতে হবে এবং প্রান্তিক করদাতাদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে। যদি প্রয়োজন হয়, সরকারের উচিত এ ধরনের অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি নিশ্চিত করতে বিদ্যমান নীতিমালা সংস্কার করা।

বাংলাদেশ কর আইনজীবী সমিতির সভাপতি মো. আবু আমজাদ বলেন, আটকে পড়া অর্থ উদ্ধারের জন্য আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। আগামীতে যাতে করের টাকা আটকে না থাকে। তার জন্য অডিটে নির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে কী কী কারণে ফাইল অডিটে পড়ে, তার সুনির্দিষ্ট কারণগুলো অডিটে উল্লেখ করা উচিত। সেটা করা গেলে আটকে পড়া অর্থের পরিমাণ কমে আসবে।

তিনি আরও বলেন, কর ফাঁকির বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য উল্লেখ না করেই আপত্তি তোলা হয়। যদি কোনো নির্দিষ্ট তথ্য উল্লেখ করে অডিট আপত্তি তোলা হয়, তাহলে করদাতারা সেই সমস্যা সমাধান করে কর দিয়ে দিতে পারেন। অধিকাংশ সময় অনুমাননির্ভর আপত্তি তোলা হয়। যে কারণে করের টাকা আটকে আছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, কর আইন লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগগুলো বেশির ভাগ করদাতা এবং রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনাল বছরে প্রায় ২ হাজার অভিযোগ নিষ্পত্তি করে। কর ফাঁকির অভিযোগ গত অর্থবছরে হ্রাস পেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধীনে কর আপিল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে দুই সদস্যের সমন্বয়ে সাতটি বিভাগীয় বেঞ্চ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচটি, চট্টগ্রামে একটি, খুলনায় একটি ও রংপুরে একটি।

জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের স্বার্থে এসব অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। সরকার ২০১১-২০১২ অর্থবছরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল যাতে এই জাতীয় অভিযোগ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা যায়, তবে এনবিআর এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে না। বাজেট ঘাটতি কমাতে এনবিআর অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারে।

এদিকে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। বাজেটের অর্থ জোগানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগৃহীত কর থেকে পাওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বহির্ভূত কর থেকে আদায় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। কর ব্যতীত প্রাপ্তির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ফলে বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ করে।

ঘাটতির মধ্যে অনুদানসহ বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৯৮ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা; আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। সরকার বাজেটের ঘাটতি মেটাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার বা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে। অডিট আপত্তির কারণে আটকে থাকা প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা আদায় করা গেলে বহুজাতিক ঋণদান সংস্থার কাছ থেকে ২৫০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলেই হতো বলে মনে করেন রাজস্ব সংশ্লিষ্টরা।

আরো পড়ুন : কারাগারে ‘গুরুতর অসুস্থ’ রুহুল কবির রিজভী

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *