চরম মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা সুনামগঞ্জে, ১০ ঘণ্টা ধরে সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

ওকে নিউজ স্পেশাল জনদুর্ভোগ জাতীয় প্রচ্ছদ লাইফ স্টাইল হ্যালোআড্ডা

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ জেলা। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাত থেকেই পানির উচ্চতা বাড়তে থাকায় একে একে প্লাবিত হতে থাকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ঘরবাড়ি। এদিকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ।

শুক্রবার (১৭ জুন) ভোর থেকেই সুনামগঞ্জ সদর নেটওয়ার্কের বাইরে। গত ১০ ঘণ্টায় সদর এলাকার কারোর সঙ্গে মোবাইলে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, দীর্ঘক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকায় বিকল হয়ে পড়েছে মোবাইল অপারেটরের টাওয়ারগুলোর ব্যাকআপ পাওয়ার সাপ্লাই। বন্ধ হয়ে গেছে ল্যান্ডফোনের সংযোগ। অন্যদিকে সড়ক যোগাযোগও বন্ধ থাকায় সারাদেশ থেকেই কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় স্বেচ্ছাসেবীরাও উদ্ধার অভিযানে বের হতে পারছে না।

সিলেট ও সুনামগঞ্জের অনেক স্থানে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও বৈদ্যুতিক খুঁটি তলিয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্তত পৌনে দুই লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন রয়েছেন। শুক্রবার (১৭ জুন) দুপুরে বিদ্যুৎ বিভাগ বিষয়টি জানায়। মানুষের ঘরে সুপেয় পানি নেই। মুঠোফোনেও নেটওয়ার্ক নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট তো রয়েছেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা।

দেশের বিভিন্ন প্রাণ ও দেশের বাইরে থেকে সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা জানান, শুক্রবার ভোর থেকেই তারা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। যে নাম্বারেই কল করা হচ্ছে সেটিই বন্ধ দেখাচ্ছে। সেসময় ঘণ্টাখানেক আগেও যার মোবাইলে ৮০ ভাগ চার্জ ছিল, সেই মোবাইল নম্বরটিও অচল দেখাচ্ছে। এ অবস্থায় স্বজনদের নিরাপত্তা নিয়ে তারা ভীষণ দুশ্চিন্তা ও শঙ্কায় পড়েছেন।

মাঝেমাঝে নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া গেলেও তা কয়েক সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। সুনামগঞ্জ পৌর কলেজের শিক্ষক জাফর আহমেদ জানান, ‘আমার বাসায় বুকসমান পানি। আমার ছয়মাস বয়সী মেয়ে ও স্ত্রীকে ফুফুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। বিছানা সহ সব আসবাবপত্র পানির নিচে। পানির কমার লক্ষ্মণ দেখছি না।’

ফেসবুকের মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তিনি জানান, হঠাৎ ডাটা সংযোগ পাওয়ায় তিনি মেসেজ ডেলিভার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু কাউকে কল করে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। গ্রামীনফোন, এয়ারটেল, রবি, বাংলালিংক, টেলিটক—কোনো অপারেটরেই নেটওয়ার্ক নেই। বিদ্যুৎ ও গ্যাস না থাকায় অবস্থা আরও করুণ। দ্রুত সেনাবাহিনী উদ্ধারকাজ না করলে বিপদ আরও বাড়বে। পানির উচ্চতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) দিবাগত রাতেই শহরের বহু ঘরবাড়ির রান্নাঘরের চুলা পর্যন্ত তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরে নেই শুকনা খাবারও। সুপেয় পানির অভাব দেখা দিয়েছে। পানির উচ্চতা বাড়তে বাড়তে ঘরের বাইরে আশপাশে বুক থেকে গলাসমান পানি উঠেছে। অথচ বিকেলেও এসব জায়গায় হাঁটু থেকে সর্বোচ্চ কোমর সমান পানি ছিল।

আবহাওয়া পূর্বাভাস ও বিভিন্ন স্যাটেলাইট চিত্র বলছে, সুনামগঞ্জের এখনো বৃষ্টিপাত অব্যাহত আছে। শুক্রবার ভোর থেকে সুনামগঞ্জের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ বিকল হয়ে পড়ায় কেউ জানেন না সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি কী। সকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সুনামগঞ্জের শিক্ষার্থীরা। নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সহ এলাকার বন্যাকবলিতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী মোতায়েন করার দাবি জানান তারা। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও গভীর শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। গত ১০ ঘণ্টায় কেউই সুনামগঞ্জে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। এমনকি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের দাপ্তরিক নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে সেটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

সিলেটে বন্যাদুর্গত বিভিন্ন এলাকায় উদ্ধার কাজ পরিচালনা করতে সেনাবাহিনী নামানো হলেও সুনামগঞ্জ সদরের সর্বশেষ পরিস্থিতি এখনো জানা যায়নি। অন্যদিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উপচে তীব্রবেগে পানি প্রবাহিত হওয়ায় অচল হয়ে আছে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা।

সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, জেলার প্রতিটি উপজেলাই কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। অধিকাংশ ঘরের ভেতরেই হাঁটু থেকে গলাসমান পানি। ইট-কাঠ দিয়ে শোবার খাট উঁচু করেও রক্ষা করা যায়নি, সেটিও পানিতে তলিয়েছে। নৌকা না থাকায় ঘরের বাইরেও বের হতে পারছেন না পানিবন্দী এসব মানুষ। বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় বাড়িঘরে আটকা পড়া বানভাসিরা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার চান। তারা খাবার ও পানির সংকটে সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। কোনো উদ্ধারকারী দল না মাঠে না থাকায় চরম মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংকট আরও বাড়ছে।

এদিকে বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে সুনামগঞ্জে সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়। সিলেটের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) দেবজিৎ সিংহ সাংবাদিকদের জানান, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলায় উদ্ধারকাজ চালাতে সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করা হয়েছে। এর আগে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, অসামরিক প্রশাসনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সিলেটে বন্যা নিয়ন্ত্রনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ইত্তেফাক অনলাইনকে বলেন, ‘সকালে সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও ত্রাণসচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। ত্রাণ সচিব উনার মন্ত্রীর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি অবহিত করেছেন। এছাড়া সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যাপারেও অনুরোধ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জাহাজে করে ত্রাণ ও খাদ্যসামগ্রী রওনা হয়েছে। সুনামগঞ্জে এখন এসওএস (SOS) পরিস্থিতি। কিন্তু মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। বানভাসিদের প্রাণ বাঁচাতে জরুরিভিত্তিতে রেস্কিউ বোট নিয়ে উদ্ধার অভিযানে নামা প্রয়োজন।’

এর আগে গত বুধবার থেকে উজান থেকে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল নামা শুরু হলে সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির তৈরি হয়। আজ শুক্রবার (১৭ জুন) সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলা সদরের সঙ্গে পাঁচটি উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসন চেষ্টা চালাচ্ছে।

আরো পড়ুন : নির্বাচনের  জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ফরম সংগ্রহের আহ্বান

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *