সংগঠনের স্বার্থে ও দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে বিএনপি

প্রচ্ছদ মুক্তমত রাজনীতি হ্যালোআড্ডা

সংগঠনের স্বার্থে ও দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে শক্ত অবস্থানে বিএনপির হাইকমান্ড। চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদারে নানামুখী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। যারা দলীয় কর্মসূচি পালনে বিরত থাকছেন বা ঢিলেমি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে সাংগঠনিক ব্যবস্থা। ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে চাঁদপুরের ৯ স্থানীয় নেতাকে শোকজ করা হয়েছে। যুক্তিসংগত জবাব না দিলে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। সেইসঙ্গে আন্দোলন সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের তালিকা করছে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর।

বিশেষত অতীতে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেয়ে যারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন, কিন্তু চলমান আন্দোলনে অনেকটা নিষ্ক্রিয় এবং মান-অভিমানসহ নানা কারণে দলীয় কার্যক্রমে চুপ থাকা নেতাকর্মীদের তালিকা করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এই তালিকায় প্রায় ৪ হাজার জনের নাম এসেছে। যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত তালিকা তৈরির পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মতবিনিময় করবেন বলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানিয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গতকাল শনিবার বলেন, ১০ দফা দাবিতে আমাদের যুগপৎ আন্দোলন চলছে। দলীয় নেতাকর্মীসহ সারা দেশের মানুষ এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অনেক সময় নানা কারণে কেউ অনুপস্থিত থাকছেন। তবে পদে থেকে কেউ দায়িত্ব বা কর্মসূচি পালন না করলে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কখনো কখনো ব্যবস্থা নিতে হয়। সেটা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখে থাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি তো সরকার পরিচালনাকারী দল। যে কারণে স্থানীয় সাবেক জনপ্রতিনিধিদের তালিকা করা বা না করার চেয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকাটা জরুরি।

দলীয় শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর বিএনপি : যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ১১ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কোথাও স্বাভাবিক আবার কোথাও হামলা-প্রতিরোধের মুখে দেশব্যাপী এই কর্মসূচি পালিত হয়। তবে চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলায় বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের নেতৃত্বে কোনো ইউনিয়নেই এই কর্মসূচি পালিত হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির শীর্ষ নেতারা ড. জালাল উদ্দিনের উপস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ রিসোর্টে পিকনিক এবং আনন্দ উৎসব করেছেন।

সেখানে দায়িত্বশীল নেতাদের উদ্দাম নৃত্যের ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরালও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং প্রকৃত ঘটনা জানতে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে চাঁদপুর-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ জালাল উদ্দিনসহ ৯ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর। একই ঘটনায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, আমি অভিযোগের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। যেহেতু তদন্তের বিষয়, এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না।

কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা জানান, তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে পৌঁছে এ অভিযোগ। দলের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং তৃণমূলের ক্ষোভ প্রশমিত করতে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে কেন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তা জানাতে তিন দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টরা জবাব দিয়েছেন।

শোকজপ্রাপ্তরা হলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও গত নির্বাচনে চাঁদপুর-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, মতলব উত্তর উপজেলা শাখার সভাপতি ফজলুল হক সরকার হান্নান, মতলব উত্তরের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক জিতু, মতলব দক্ষিণের সভাপতি এনামুল হক বাদল, মতলব দক্ষিণের সাবেক সভাপতি এমদাদ হোসেন খান, মতলব উত্তরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলমগীর সরকার, ছেঙ্গারচর পৌরসভা শাখার সভাপতি নান্নু মিয়া প্রধান, ছেঙ্গারচর পৌরসভা শাখার সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধান এবং মতলব উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক মিয়া মঞ্জুর আমিন স্বপন।

বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া বলেন, এটি একটি সাংগঠনিক বিষয়। সংগঠনের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে অনেক সময় কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এজন্যই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ওনারা জবাবও দিয়েছেন।

চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক বলেন, এ বিষয়টি সরাসরি কেন্দ্র থেকে করা হয়েছে। আমাদের সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না।

এদিকে ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, কর্মসূচি সফল করতে ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে মতলবে আমার নিজ বাসায় দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা করি। কিন্তু শনিবার সকালে দু-একটি ইউনিয়নে কর্মসূচি পালন শুরু হলেও সেদিন আওয়ামী লীগ নেতা মায়া চৌধুরী, সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি এবং সাবেক সেনাপ্রধান মতলবে অবস্থান করায় মতলব উত্তর থানার ওসি আমাকে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার অনুরোধ করেন। নতুবা গ্রেপ্তারের কথা বলেন। এমতাবস্থায় দুপুরে নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। পথে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ এলাকায় ‘হৃদয়ে মতলব’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের পূর্বনির্ধারিত পিকনিকে অংশগ্রহণ করি। যেহেতু আমরা ভোটের রাজনীতি করি, সেহেতু সবার মন রক্ষা করেই আমাদের চলতে হয়। দলীয় কর্মসূচি বাদ দিয়ে এটিকে আনন্দ ফূর্তির অভিযোগ বলা অত্যন্ত দুঃখজনক। মূলত অভিযোগটি সঠিক নয়।

তালিকা হচ্ছে নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের : এদিকে দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নামতে চায় বিএনপি। সেজন্য নানা কারণে রাগে-ক্ষোভে এবং অভিমানে দূরে থাকা নেতাকর্মী কিংবা সমর্থকদের একই ছাতার নিচে আনতে কাজ করছে দলটি। এ প্রক্রিয়ায় অতীতে বিএনপির সমর্থনে বিজয়ী স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ দিকে। এর মধ্যে রয়েছেন সাবেক ও বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর। তবে দীর্ঘদিনের বিরতিতে কাজ শুরু করায় মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে অনেক টিমকে হিমশিম খেতে হয়েছে। অনেক জনপ্রতিনিধির খোঁজ মিললেও তাদের বিস্তারিত তথ্য মেলেনি। কিছু এলাকায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও কোনো তথ্য দিতে পারেননি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বিএনপির দপ্তর সূত্র জানায়, গত ২৯ জানুয়ারি থেকে এ তালিকা তৈরির জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া এবং ১০ বিভাগে সাবেক ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে পৃথক টিমও গঠন করা হয়। যার সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু। এসব টিম সারা দেশ সফর শেষে ইতোমধ্যে তালিকার কাজ প্রায় শেষ করেছে। এখন দলের দপ্তর শাখায় চলছে তালিকা সমন্বয়ের কাজ। ইতোমধ্যে দলসমর্থিত প্রায় ৪ হাজার জনপ্রতিনিধির খোঁজ পাওয়া গেছে।

১৯৯১ এবং ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপির সমর্থনে জনপ্রতিনিধি হওয়া অসংখ্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি রাজনীতি থেকে দূরে আছেন। কেউ পদবঞ্চিত হয়ে অভিমানে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন, অনেকে মামলা-হামলার ভয়ে চুপ আছেন। অনেকে মূল্যায়নের অভাবে রাজনীতি থেকে হারিয়েও গেছেন। এ ছাড়া ২০০৯ সাল থেকেও অনেকে বিএনপির সমর্থনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেও নিষ্ক্রিয়। এখন এসব নিষ্ক্রিয় সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিকে একই ছাদের নিচে আনার কাজ চলমান। সব কাজ শেষ করে দলের হাইকমান্ড এসব সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করবেন, তাদের চাওয়া-পাওয়া, সুবিধা-অসুবিধা জানার চেষ্টা করবেন। বিভাগ কিংবা জেলা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে পৃথকভাবে স্কাইপিতে কথা বলবেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সাবেক জনপ্রতিনিধিদের ‘ইমেজ’ কাজে লাগিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে চায় বিএনপি।

বিএনপির সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, বিএনপি হচ্ছে গণমানুষের দল। এই দলের হয়ে অনেকেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হয়ে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান তৈরি করেছেন। তৃণমূল থেকে দলকে সংগঠিত করতে অনেকের অবদান রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে অনেকেই নিষ্ক্রিয় আছেন। এখন তাদের দলের সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত করতে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আরো পড়ুন : নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগের কর্মিসভায় দর্শক সারিতে শামীম ওসমান

Share The News

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *